আ.লীগের সুসময়-দুঃসময়ের সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
প্রথম নিউজ, ঢাকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী বরেণ্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক তার জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্থান-পতনের সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাকের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২৩ ডিসেম্বর)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সময়ের উত্থান-পতনের সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাকের জন্ম শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে ১৯৪২ সালের ২ মে। তার বাবার নাম ইমাম উদ্দিন ও মায়ের নাম আখফাতুননেসা। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম পাইলট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৬০ ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ষাটের দশকে আব্দুর রাজ্জাক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্র থাকাকালীন আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক পর পর দুইবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বয়স ৩০ পেরোনোর আগেই আব্দুর রাজ্জাক জাতীয় রাজনীতিতে একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন। এসব লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন। এ সময় তিনি কারাগার থেকেই মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরপর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ৬ দফার আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক কারারুদ্ধ ছিলেন।
আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক ও মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক। তিনি দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। মুজিব বাহিনী কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেসের অন্যতম রূপকার ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন।১৯৭০ সালে আব্দুর রাজ্জাক প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ১৯৭৩ সালেও জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করা হলে তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বাকশালের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যা করার পর আব্দুর রাজ্জাক গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করলে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হলে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে তিনি উদ্যোগী হয়ে পুনরায় বাকশাল (রাজ্জাক) গঠন করেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর আব্দুর রাজ্জাক বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে ১৯৭০ সালে ছাত্রজীবনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ফরিদপুর-১৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের সংসদীয় একটি প্রতিনিধিদল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে।
২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর তার ছেলে নাহিম রাজ্জাক এখন পর্যন্ত শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা, গোসাইরহাট, ভেদরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য।
জাতীয় বীর আব্দুর রাজ্জাকের মতো রাজনীতিবিদরা দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার পাত্র। প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সাধারণ জনতা, আওয়ামী লীগ, আব্দুর রাজ্জাক স্মৃতি সংসদ, আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার বনানীতে তার সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। এ ছাড়া শরীয়তপুরের বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে আব্দুর রাজ্জাকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ দোয়া মাহফিল হয়েছে।
প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাড়া-মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাসহ সারা দেশে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সময়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ পরবর্তীতে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আব্দুর রাজ্জাক কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন। তার মতো নেতা বাংলাদেশে দ্বিতীয়জন তৈরি হওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। এখনো সাধারণ মানুষসহ দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে আব্দুর রাজ্জাক শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।