আনারকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ডিবি প্রধান হারুন
রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বসে হত্যার পরিকল্পনা করেন নিহতের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আকতারুজ্জামান শাহীন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বসে হত্যার পরিকল্পনা করেন নিহতের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আকতারুজ্জামান শাহীন। তার পরিকল্পনায় হত্যাকান্ড ঘটান পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া। শাহীন দুই-তিন মাস ধরে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে গোয়েন্দা পুলিশের শক্তিশালী তদন্ত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কলকাতাকে বেছে নেন। আধা ঘণ্টার মধ্যেই নৃশংস ও বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, কলকাতায় ১৩ই মে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনারকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশ গুম করার জন্য পৈশাচিকভাবে মরদেহ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে ঘটনায় জড়িত মূল হত্যাকারীসহ গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি, সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দুই-তিন মাস আগে। ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরায় বসে একাধিকবার আলোচনা করেছেন তারা।
আনারকে হত্যা করতে প্রথমে তারা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ডিএমপি’র ডিবি তদন্ত সক্ষমতার কথা চিন্তা করে তারা দেশের বাইরের মাটিতে পরিকল্পনা করেন। এর অংশ হিসেবে এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ কলকাতায় তারা বাসা ভাড়া করেন। সে বাসায় নিহত সংসদ সদস্যের বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীন, তার বান্ধবী এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ওঠেন। মূলত পরিবার নিয়ে থাকার তথ্য দিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।
তিনি বলেন, হত্যাকারীরা দুই মাস ধরে সংসদ সদস্যকে নজরদারিতে রাখছিলেন, কখন তিনি কলকাতায় যান। এই সংসদ সদস্য বিভিন্ন সময়ে কলকাতায় যেতেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন বাস করেছেন। সেখানে তার বন্ধু-বান্ধব রয়েছেন। তারা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। সংসদ সদস্য আনার কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। তারা জানতেন ১২ই মে সংসদ সদস্য আজিম কলকাতায় যাবেন। হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ৩০শে এপ্রিল কলকাতায় গিয়ে স্থানীয় দুজনকে ঠিক করেন। তারা হলেন-জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়াম। হত্যার পরিকল্পনাকারী শাহীন হত্যার পর কোন গাড়ি ব্যবহার করা হবে, কাকে কতো টাকা দিতে হবে- সেগুলো ঠিক করে ১০ই মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নিহত সংসদ সদস্য কলকাতায় যাওয়ার পর ১৩ তারিখ ওই বাসায় যান। যাওয়ার পথে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যান। গাড়িটি কিছু পথ যাওয়ার পরে হত্যাকারী আমানউল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠেন। গাড়িটির চালক ছিলেন রাজা। সেই বাসায় যাওয়ার পর মোস্তাফিজসহ তারা বাসায় প্রবেশ করেন। বাসাটিতে আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবস্থান করছিলেন। ১৩ তারিখ দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন আনোয়ারুল আজিম। এর ৩০ মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় তাকে। হত্যার পরে ঘাতকেরা সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠান। এরপর তারা মরদেহের হাড় থেকে মাংস আলাদা করেন। পরবর্তীতে দুটি ব্রিফকেসে করে জিহাদ ও সিয়াম মরদেহ গাড়িতে করে ফেলে দেন যাতে হত্যার পরে সংসদ সদস্যের চিহ্ন না থাকে। কাজ শেষ করে ১৫ তারিখে আমান উল্লাহ ও শাহীনের প্রেমিকা সিলিস্তি রহমান দেশে ফিরে আসেন। সবাই ফিরে আসায় হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন বিমানে করে দিল্লি গিয়ে সেখানে ২ ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে কাঠমাণ্ডু চলে যান। সেখান থেকে অন্য কোনো দেশে চলে যান তিনি।
হারুণ অর রশীদ আরও বলেন, বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেছে, হত্যাকারীরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে নিহত সংসদ সদস্যের দুটি মোবাইল ফোন দুইদিকে নিয়ে যান। এরপর তারা বিভিন্নজনকে বার্তা পাঠানো ও কল করতে থাকেন, যাতে তদন্তকারীরা বুঝতে পারেন তিনি জীবিত আছেন। এমন কী গত ১৮ তারিখ এমপি’র ব্যক্তিগত সহকারীকে একটি মেসেজ পাঠায়, ‘আমি দিল্লি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আছেন। দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র সঙ্গে আমার একটি মিটিং আছে।’ এই বার্তাগুলো আমরা যখন পেয়েছি, তখনই বুঝতে পেরেছি হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতে এই বার্তা পাঠিয়েছেন। হত্যাকারীরা দুটি মোবাইল ফোন কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাঠিয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারতের পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাদের একটি দল এখানে এসেছেন। আমাদের হাতে আটক যে আসামি রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন, জিজ্ঞাসা করবেন। আমরাও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাবো।
মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা- জানতে চাইলে ডিবি’র এই কর্মকর্তা বলেন, লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কতোটুকু বলা সম্ভব না। তবে শিমুলের বর্ণনা মতে আসলে আনারের মরদেহ তো খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে। হাড্ডি মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা আসলে কাজ করছি। মামলার আগেই হতে পারে। কলকাতা পুলিশ তো নিশ্চিত হয়েছে হত্যা হয়েছে। যে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করেছে সে কলকাতা পুলিশের কাছে আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। কেন হত্যাকাণ্ড সেটি তো বের হবেই, তবে কারা কারা জড়িত, আরও কেউ জড়িত কিনা, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা আশা করছি- পুরোপুরি না পেলেও খণ্ডিত হলেও মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে। আমাদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সব অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা। কী কারণে হত্যা সেটা পরে দেখবো। ইন্ডিয়াতে যারা যারা সহযোগিতা করেছে তাদের সঙ্গে টাকা-পয়সার লেনদেন করেছে মূল মাস্টারমাইন্ড। আমাদের কাছে ৩ জন আছে। কলকাতা পুলিশের কাছে আছে একজন।
উল্লেখ্য, গত ১২ই মে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। তিন দিন পার হলেও পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। বুধবার খবর এলো ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিমের খুন হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদিকে আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে খুন হওয়ার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় মামলার এজাহার দায়ের করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন।
Download Apps for Android: https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews&hl=en&gl=US