আনন্দবাজারের রিপোর্ট নিয়ে ভারতীয় হাই কমিশনার যা বললেন
শনিবার বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেবল অটুট নয়, আগামী দিনে আরও সুদৃঢ় হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। বঙ্গবন্ধুকে দুই দেশের সম্পর্কের প্রাণ পুরুষ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তাঁর হাত ধরে ১৯৭১ সালে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। সেই বন্ধন প্রতিবেশী দেশ দুটির ‘শক্তিশালী সম্পর্ককে’ এগিয়ে নিচ্ছে। হাই কমিশনার বলেন, যুদ্ধের ময়দানে পারস্পরিক সম্মান থেকে আবদ্ধ প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক ইতিহাসের বাকি সময়েও অটুট থাকবে। শনিবার বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিসহ অন্যরা অত্যাসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করতে স্বতন্ত্র ভিসানীতি ঘোষণাসহ যুক্তরাষ্ট্রের নানামুখী চাপ এবং অতীতের বিভিন্ন ঘটনার কড়া সমালোচনা করেন। তবে ভারতীয় দূত বঙ্গবন্ধু এবং দুই দেশের মৌলিক সম্পর্কের বাইরে তেমন কিছু বলেননি।
স্মরণ করা যায়, ভারতীয় হাই কমিশনার যখন বক্তব্যটি রাখছিলেন, তখন ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আনন্দবাজারের সূত্রবিহীন একটি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। আনন্দবাজার দাবি করেছে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার বর্তমান ভূমিকায় ভারত যে খুশি নয়, সেই বার্তা নাকি ওয়াশিংটনকে পৌঁছে দিয়েছে নয়াদিল্লি। রিপোর্টে অগ্নি রায় লিখেন- ঢাকায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হোক এটা ওয়াশিংটনের মতো ভারতও চায়। কিন্তু যেভাবে হাসিনা সরকারকে অস্থির করার জন্য আমেরিকার তরফে বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয়।
বাংলাদেশে হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং আমেরিকা কারও পক্ষেই সুখকর হবে না এমন মন্তব্য করে বলা হয়, কূটনৈতিক সূত্রে খবরটি বেরিয়েছে। এ-ও বলা হয়, একাধিক স্তরের বৈঠকে নাকি নয়াদিল্লি বিষয়টি বাইডেন প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটনকে নাকি বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনোভাবে জামায়াতকে আস্কারা দেয়, তাহলে একদিকে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বাড়তে পারে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার দুপুরে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বক্তব্য রাখছিলেন ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সেই সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে প্রণয় ভার্মা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায় বিচার, অমায়িক আত্মা এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে অসাধারণ আত্মনিবেদন এই অঞ্চলের সকল প্রজন্মের মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের এই উন্নয়ন শান্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পাশে থাকতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
হাই কমিশনার আরও বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংযোগ, নিরাপত্তা এবং দুই দেশের মানুষের বন্ধন প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা শুধু আজকে অতীতের স্মৃতি মনে করছি না। একইসঙ্গে আগামী দিনগুলোকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। দুই দেশের একসঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। একইভাবে সাম্যতা, ন্যায় বিচার ও সততা নিয়ে এগুচ্ছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী
এদিকে ভারতীয় হাই কমিশনারের পর সভায় বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। হাই কমিশনারকে সামনে রেখে তিনি বলেন, ইচ্ছা করলেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না। কারণ দেশটির সঙ্গে আমাদের রক্তের বন্ধন। ভারতের সহযোগিতা ছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। দু’দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তা বর্তমান সরকারের সময়ে আরও দৃঢ় হচ্ছে। ভারত স্বাধীনতাযুদ্ধে রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। ১ কোটি মানুষকে থাকতে দিয়েছে। খাবার প্রদানসহ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ-অস্ত্রসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়েছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিলো, কিন্তু পারে নি। পরবর্তীকালে (১৯৭১ সালের) ১৪ ডিসেম্বর তারা যুদ্ধে স্থিতাবস্থার প্রস্তাব করেছিল। তাদের সেই প্রস্তাব মানলে পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হতো না। তাদের কথামতো কাজ হলে পাকিস্তান টিকে যেতো। আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না। মন্ত্রী বলেন, শুধু তা-ই নয়, এরপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে দেশে দুর্ভিক্ষের পেছনেও তাদের হাত ছিল। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু নগদ পয়সায় আমেরিকার কাছ থেকে চাল ও গম কিনলেন। কিন্তু তা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এসে পৌঁছায়নি। এতেই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি, এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সমস্ত পথ খুব সুকৌশলে তারা তৈরি করলো। মন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণাসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছে। এসব পদক্ষেপ সাময়িক নয় বরং দীর্ঘ মেয়াদি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত মাথাব্যথা কেন? এই বছর তো পৃথিবীর প্রায় ২১টি রাষ্ট্রে নির্বাচন হবে। কিন্তু সেসব দেশে কোনও কথা নেই। পাকিস্তানে কোনও কথা নেই, আফগানিস্তান নিয়েও কোন কথা নেই। কেন? কেবিনেটের জ্যেষ্ঠ ওই প্রতিনিধি বলেন, আজকে আমেরিকা মানবাধিকারের কথা বলছে। কিন্তু '৭০ সালে আওয়ামী লীগ যখন ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হলো, সেদিন ক্ষমতা হস্তান্তর হলো না। তখন তাদের মানবতাবোধ কোথায় ছিল? মন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমানের সময় ভোটের নামে যা হয়েছে সেদিনতো আমেরিকা কিছু বলে নাই। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর মানবতার পক্ষে কিছু না করে উল্টো তার আত্মস্বীকৃত খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। এতেই তো প্রমাণ হয় ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডে তারা সম্পৃক্ত!
আলোচনায় অন্য বক্তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতাকারী ভারতের সঙ্গে নিরাপদ সীমান্ত, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রশিদুল আলম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নারায়ন সাহা মনি। গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, সংসদ সদস্য আরমা দত্ত ও বাসন্তী চাকমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমিতির প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হক।