সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ব্যাংক লোপাটকারীদের উৎসাহিত করবে: এ কে আজাদ
গতকাল রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে বিনা অনুমতিতে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ব্যাংক লোপাটকারীদের উৎসাহিত করবে বলে মন্তব্য করেছেন সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশনের (নোয়াব) সভাপতি ও সংসদ সদস্য এ কে আজাদ। তিনি বলেন, দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি বাড়ছে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় থাকছে না। তাই জবাবদিহিও মিলছে না। এসব নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে বিনা অনুমতিতে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদ থেকে এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যাংক লোপাটকারীদেরই উৎসাহিত করবে। গতকাল রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
‘গ্রহের জন্য গণমাধ্যম: পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় সাংবাদিকতা’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন, ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন প্রমুখ।
নোয়াব সভাপতি বলেন, বর্তমানে দেশে ৯টি আইন রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। আরও ৩টি আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এর পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের বিষয়টি ধরলে এমন আইনের সংখ্যা হবে ১৩। প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের খসড়া বারবার দেখতে চাওয়া সত্ত্বেও গণমাধ্যমের কাউকে দেখতে দেয়া হয়নি। এ সময় তিনি দেশে সংবাদিক নিপীড়ন ও হত্যার পরিসংখ্যান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থান, মফস্বল সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমের সুরক্ষা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের অঙ্গীকার আছে এবং থাকবে। তবে রাজনীতি ও বিভিন্ন পেশার মতো তথ্যের সঙ্গেও অপতথ্যের বিস্তৃতি আমরা দেখি। অপসাংবাদিকতাও দেখি। সেটি শুধু আমি বলছি না, সাংবাদিক বন্ধুরাও বলেন। তিনি বলেন, সরকার যারা পরিচালনা করেন তারা সবাই ফেরেশতা নন। সরকারের ব্যত্যয়-বিচ্যুতি ধরিয়ে দেবে সাংবাদিকরা। এ ধরনের সব সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে যখন সমালোচনার নামে অপতথ্য, মিথ্যাচার, অপপ্রচারের মাধ্যমে এক ধরনের এজেন্ডা বেইজড, সিস্টেমেটিক মিথ্যাচার ছড়ানো হয়, সেগুলো আমরা বুঝি কে করছে, কারা করছে, কেন করছে। সেই বিষয়গুলোর আমরা নিন্দা জানাই। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য গণমাধ্যম আছে, এটি গণমাধ্যমের দায়িত্ব। গঠনমূলকভাবে ধরিয়ে দিলে সেটি স্বীকার করে নিতে এবং সেগুলো শুদ্ধ করে নিতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ সাংবাদিকতায় সরকার প্রণোদনা, উৎসাহ দিতে চায়। এখানে বিরোধের কোনো জায়গা দেখি না। সাংবাদিকরা সঠিক তথ্য দিয়ে পরিবেশ নিয়ে প্রতিবেদন করবেন, তাদের পূর্ণ সহায়তা দেয়া হবে। কারণ এটা সরকারের কেন্দ্রীয় নীতির অংশ। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যারা এখানে সহায়তা করবেন, তারা আমার এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন পাবেন। তৃণমূলে যতই কঠিন বাস্তবতা তৈরি করা হোক না কেন, তাদের সুরক্ষা এবং যত ধরনের সহযোগিতা লাগে, তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সব সংগঠনের সঙ্গে বসেছি। সবাই একটা কথা বলেছে, যেসব গণমাধ্যমের রেজিস্ট্রেশন নেই সেগুলো বন্ধ করে দিতে। নোয়াব সভাপতি বলেছেন- মফস্বলে সাংবাদিকতা কঠিন। আমি একমত। ঢাকায় অনেক প্রোটেকশন পাওয়া যায়, মফস্বলে পাওয়া যায় না। সেটা নিশ্চিতে আমরা কাজ করবো। একইসঙ্গে সেখানে আবার অপসাংবাদিকতার চর্চা অনেক হয়, পেশাদারিত্বের অভাব দেখা যায়। যেটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে পেশাদার সাংবাদিকদের। তাই তারা বলছেন এখানে শৃঙ্খলা আনা দরকার। সব সাংবাদিক সংগঠন বলছে, এখানে ন্যূনতম কোয়ালিফিকেশন থাকা দরকার। অন্য প্রফেশনে আছে এখানে থাকবে না কেন। এখানে ডিসিপ্লিন আনা দরকার। অনেকে বলতে বলতে নিয়ন্ত্রণ, রেগুলেশনও বলে ফেলছেন। আমার শুনতে বিব্রত লাগছে। সাংবাদিকতায় নিয়ন্ত্রণ, রেগুলেশনে আমরা বিশ্বাস করি না।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি কিছুদিন আগেও বলেছি যে, যেসব পত্রিকার অনলাইন আছে, অন্যান্য নিউজ পোর্টালসহ সবগুলোর তালিকা আমরা করছি। এর বাইরে অনেক পোর্টাল খোলা হয় অপসাংবাদিকতা করার জন্য। আমি বলেছি, সেগুলো লিস্ট করে মন্ত্রণালয়ে দিলে বিটিআরসিকে বলে বন্ধ করে দেবো। আমি সাংবাদিক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে সেগুলো করছি। অর্থাৎ যেগুলো আনরেজিস্ট্রার্ড সেসব আমরা বন্ধ করে দেবো। তবে যারা আবেদন করছে তাদেরগুলো অন রাখা হবে। কারণ অপেশাদারদের দায় কেন পেশাদার সাংবাদিকরা নেবে। এ ধরনের কিছু পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি। তিনি বলেন, ডিসিপ্লিন তখনই দরকার হয় যখন ইনডিসিপ্লিন থাকে। এখানে একটা কোয়ালিফিকেশনের দরকার। আবার গণমাধ্যমকর্মী আইন নিয়েও নানা কথা আছে। যে আইনটি সংসদে উঠেছিল, পরে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে গিয়েছে। আমি আইনটি নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করবো। যতগুলো সাংবাদিক সংগঠন আছে সবার থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছে। প্রত্যেকে তাদের কথা বলবেন, সেটিকে পর্যালোচনা করে স্ট্যান্ডিং কমিটির মাধ্যমে সংসদে পাস করাবো। এ বিষয়গুলো আসলে মনে হয় আমাদের দেশে গণমাধ্যম মুক্ত শুধু নয়, উন্মুক্ত হয়ে আছে। এখানে যেহেতু কোনো রেগুলেশন নাই, তাই এটি উন্মুক্ত। সাংবাদিক বন্ধুরাই এখন বলছেন, এখানে শৃঙ্খলা দরকার। বিশৃঙ্খলা থাকার কারণেই শৃঙ্খলার কথা আসছে। তাই ওই বর্ডার লাইনটা একটু টানা দরকার। আমরা প্রচ-ভাবে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম যত মুক্ত হবে, তার স্বাধীনতা যত চর্চা করবে এবং অপতথ্যের বিপরীতে যত তথ্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে ততই সমাজে গুজব, অপপ্রচার এগুলো রোধ হবে এবং আমি মনে করি, সরকারের মধ্যে সেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গাও তৈরি হবে। আমরা (সরকার) মনে করি, গণমাধ্যম এবং পেশাদার সাংবাদিকতা আমাদের বন্ধু। তারা আমাদের সহযোগিতা করেন। কারণ যেসব সমস্যা আমাদের চোখে পড়ে না, সেটি তারা দেখিয়ে দেন এবং আমরা সেখানে গিয়ে কাজ করতে পারি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট যেটা আছে আছে, সেটা আমি পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্বাস করি। রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের অধীনে কোনো গণমাধ্যম জনগণের পক্ষে যে তথ্য চাইবে সেটা আমি তড়িৎ গতিতে দিতে বাধ্য থাকবো। এ ধরনের মানসিকতা তৈরি করার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা ওরিয়েন্টেশন করবো। কারণ তথ্য দিলে আমার কোনো সমস্যা নেই তো। যদি না আমার মধ্যে কোনো গলদ থাকে। যে তথ্য পাওয়ার অধিকার মানুষের আছে, সেটি দিতে হবে। এটি আমি নিশ্চিত করবো। একইসঙ্গে বলতে চাই যেগুলো সংবেদনশীল তথ্য, যেগুলো প্রাইভেসি অ্যাক্টের মধ্যে পড়ে, এগুলো যদি কেউ চুরি করে প্রকাশ করার চেষ্টা করে, সে চোর। তার কোনো পেশা আমরা দেখবো না। এই ধরনের সেনসেটিভ অ্যান্ড সিক্রেট ইনফরমেশন প্রটেকশনের আইন সব দেশে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব তথ্য দিতে হবে যেগুলো মানুষের জানার অধিকার আছে। একইসঙ্গে সংবেদনশীল তথ্য গোপন রাখবে। কাজেই একটি সিস্টেম করতে হবে যাতে সব তথ্য তারা অবহিত করতে পারে, আবার সংবেদনশীল তথ্য প্রটেকশনটাও রাখা জরুরি। আমরা এটি ঘেটে দেখছি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো কীভাবে অপারেট করে। সাংবাদিকদের এক্সেস কতটুকু আছে? আন্তর্জাতিক যে স্ট্যান্ডার্ড আছে, তার মধ্যে আমরা সবকিছু রাখার চেষ্টা করবো।
এ সময় তথ্য প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু ডিএসএ’র মামলায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা এখনো কারাগারে। একটি আইন মনে করা হলো প্রয়োজন নেই, চলে গেল। কিন্তু সেই আইনে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা জেল খাটছেন, এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না।