বাংলাদেশের নতুন যাত্রা

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ

বাংলাদেশের নতুন যাত্রা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ শপথগ্রহণ করেছে। বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে আয়োজিত শপথ অনুষ্ঠানে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন। পরে ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে ১৩ জন শপথগ্রহণ করেন। তিন উপদেষ্টা ঢাকার বাইরে থাকায় তারা পরে শপথ নেবেন বলে জানানো হয়। উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার’র সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ড. আ. ফ. ম খালিদ হাসান, উবিনীগ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম,  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকী আজম, বীরপ্রতীক পরে শপথ নেবেন। 

শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। বীর শহীদ ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনীর প্রধান হাসান মাহমুদ খান উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিণী অধ্যাপক আফরোজী ইউনূসও তার পাশে ছিলেন। 

আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান, জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নুল আবেদীন,  চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ, সিপিবি’র মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মোস্তাক হোসেন, এনডিএমের  চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ড. রেজা কিবরিয়া, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর, গণঅধিকারের অপর অংশের সভাপতি মিয়া মশিউজ্জামান, এনপিপি’র চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এলডিপি’র একাংশের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপা’র খন্দকার লুৎফর রহমান, বাসদের খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অংশ নেননি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। 

অনুষ্ঠানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কাউকে দেখা যায়নি। শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দেখা যায়নি। তার আসনটি শূন্য ছিল।

অপরদিকে বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী বঙ্গভবনে আসলেও বঙ্গভবনের সামনে অবস্থানরত ছাত্র-জনতা ‘ভুয়া, ভুয়া’ ধ্বনি তোলেন। তারা তার গাড়ির গতিরোধ করেন। পরে তিনি সেখান থেকে ফিরে যান। ১/১১-এর পর বঙ্গভবনে কোনো শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতারা অংশ নেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ অনুষ্ঠান বিএনপি বর্জন করেছিল। 

ড. ইউনূসের জন্য প্রস্তুত যমুনা: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা। যমুনা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এবং কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হবে বলে জানা গেছে।

বিশৃঙ্খলা-সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করুন: দুপুর ২টা ১০ মিনিট। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পূর্বনির্ধারিত সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন, একটি ছোট অস্ত্রোপচারও হয়েছে তার। গতকাল ড. ইউনূসকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানের পাশাপাশি নবনিযুক্ত আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। এরপর তিনি সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এসময় বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমকে প্রতিক্রিয়া জানান ড. ইউনূস। 

তরুণ সমাজের প্রশংসা করে তিনি বলেন, যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন বিজয় সৃষ্টি করলো সেটাকে আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এরা এই দেশকে রক্ষা করেছে, দেশকে নতুনভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছে। এই পুনর্জন্মে বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে পারে এটিই আমাদের শপথ। সেটি আমরা রক্ষা করে এগিয়ে যেতে চাই। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ড. ইউনূস বলেন, আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে। আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে, এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য একটা সাহসী যুবক বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে কোনো যুবক-যুবতী হার মানে নাই, সামনে এগিয়ে গেছে। তারা বলছে- যত গুলি মারো আমরা আছি। যার কারণে বাংলাদেশ জুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে। যার কারণে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করলো। স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। শুধু রক্ষা করা নয়, প্রতিটি মানুষের ঘরে এই স্বাধীনতা পৌঁছে দিতে হবে। তা না হলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নাই। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। 

তরুণদের উদ্দেশ্যে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন, সুযোগের পরিবর্তন, সন্তানের ভবিষ্যতের পরিবর্তন। এটা যেন সকলে বুঝে নেয়। এবং আজকের তরুণ সমাজকে বোঝানো যে, এই দেশ তোমাদের হাতে, তোমরা এটা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তোমরা যেহেতু স্বাধীন করতে পেরেছো, মনের মতো করে গড়তেও পারবে। তোমাদের দেখে সারাবিশ্ব শিখবে কীভাবে তরুণ সমাজ একটা দেশ গ্রহণ করতে পারে এবং সেটাকে পাল্টে ফেলতে পারে। আমি উপদেশ দেই- পুরনোদের বাদ দাও, তাদের এই পুরনো চিন্তা দিয়ে আমাদের মুক্তি হবে না। এটা শুধু বাংলাদেশের কথা না, সারা দুনিয়াকে নিয়েই বলছি। তোমাদের মধ্যে যে সৃজনশীলতা আছে সেটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এটা বই-খাতাতে লেখার জিনিস না, স্থাপন করার জিনিস। আমাদের দায়িত্ব হলো তারা যেটা অর্জন করে নিয়ে আসছে তাদের দিয়ে আমাদের সকল কাঠামোগুলো পরিষ্কার করে দেয়া। 

জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সরকার বলে একটা জিনিস আছে, কিন্তু এতে মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে সরকার দমনপীড়নের একটা যন্ত্র, সব সময় তাকে সামাল দিয়ে চলতে হবে। এটা সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে যে আমাকে সাহায্য করবে। আমার সরকার আমার জন্য দাঁড়াবে। যে সরকার হবে সে মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষের আস্থাভাজন হবে। সে সরকারি লোক দেখলেই মনে করবে এটা আমার লোক, আমাকে রক্ষা করার লোক। সেই আস্থাটা আমাদের মানুষের মনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, সারা বাংলাদেশ আমাদের একটা বড় পরিবার। এই পরিবারে আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। এই পরিবারে আমাদের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে সেটা সরিয়ে রাখতে চাই। যারা বিপথে গেছে তাদের পথে আনতে চাই; যাতে করে একসঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি। 

দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ মানুষকে আঘাত করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ নষ্ট করছে, চুরি করছে। অফিস- আদালত আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণ করছে-এগুলো ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাইবোন। তাদের রক্ষা করে একটা শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা-এগুলো অগ্রগতির বড় শত্রু। তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হাতে দিয়ে হোক বোঝাতে হবে। মেরে-পিটিয়ে বোঝানোটা ঠিক না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন হতে হবে যেন আমরা নিশ্চিত থাকবো যে, এর একটা বিহীত হবে। আবার আমরা তাদের হাতে দিয়ে দিলাম আর দুটো টাকা নিয়ে ছেড়ে দিলো, এটা যেন না হয়। সেই আস্থাটা আমাদের আনতে হবে। কাজেই আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা আমাদের প্রথম কাজ। এটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা অগ্রসর হতে পারবো না। 

দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্ররা আমার ওপরে আস্থা রেখে আমাকে আহ্বান জানিয়েছে, তাদের ডাকে আমি সাড়া দিয়েছি। আপনারা যদি আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন- তাহলে নিশ্চিত হবে দেশের কোনো জায়গায় কারও ওপরে হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি আপনারা না শোনেন তাহলে আমার প্রয়োজনীয়তা এখানে নাই, তাহলে আমাকে বিদায় দেন, আমার কাজে ব্যস্ত থাকি। তিনি বলেন, আমাকে প্রয়োজন মনে করলে আপনাদের দেখাতে হবে যে, আমার কথা আপনারা শোনেন। আমার প্রথম কথা হলো- আপনারা বিশৃঙ্খলা-সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন যেন ছাত্ররা আমাদের পথ দেখায়, সেই পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। বাংলাদেশ খুব সুন্দর একটি দেশ, সম্ভাবনাময় দেশ। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। এখন আবার আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তাদের দিকে আমরা তাকাবো এবং তাদের নির্দেশিত পথে আমরা অগ্রসর হবো। এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন- সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীর প্রধানরা যারা আছেন তাদের প্রতি অনুরোধ আমরা একটা পরিবার। এটার মধ্যে যেন আমাদের গোলযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে একসঙ্গে চলতে পারি। আমরা ত্বরিতগতিতে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। আপনাদের সবার কাছে আবেদন আমাদেরকে সেই সুযোগ দেন।

ড. ইউনূস বলেন, পৃথিবীর সবাই আগ্রহ করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। যখন ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে অভিনন্দন এসেছে। তারা অবাক হয়ে গেছে। সবার গা শিউরে উঠেছে। বাইরের দেশ থেকে বলছে অবিশ্বাস্য কাণ্ড। আমাদের এই সংবাদ পেয়ে তাদের তরুণরাও জেগে উঠেছে। আমরা আজকে থেকে যাত্রা শুরু করলাম, আশা করি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারবো। 

এসময় উপস্থিত সাংবাদিকরা ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি বলেন, আজকে কোনো প্রশ্ন নয়। কথা তো হবেই। এরপর কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে ড. ইউনূস বিমানবন্দর থেকে বের হন। তাকে গাড়িবহর সহ নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে মূল সড়ক হয়ে ড. ইউনূস তার নিজের গুলশানের বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

ড. ইউনূসের বর্ণাঢ্য জীবন: বিশ্বে 'গরিবের ব্যাংকার' হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের জনক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮শে জুন চট্টগ্রামের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ ও ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক্স এ যোগ দেন। পরে ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ইউনূস ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ১৯৬৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অধ্যাপক ইউনূস টেনেসির ন্যাশভিলে নাগরিক কমিটি গঠন করেন। 'বাংলাদেশ নিউজলেটার' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্যান্য বাংলাদেশীদের সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র চালু করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অন্যদের সমর্থন আদায় এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করতে মার্কিন কংগ্রেসের সমর্থন আদায়ে  লবি করার উদ্দেশ্যে তিনি এসব উদ্যোগ নেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. ইউনূস ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে খুব কাছে থেকে দেখা ড. ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং তার অর্থনীতি বিভাগের একাডেমিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নতুন ধরনের কৃষি সমবায় 'নবযুগ তেভাগা খামার সংগঠিত করেন, যা পরবর্তীতে সরকার প্যাকেজড ইনপুট প্রোগ্রাম হিসেবে গ্রহণ করে।

১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় জনতা ব্যাংক থেকে তার প্রকল্পের মাধ্যমে জোবরা গ্রামের গরিব মানুষদের ঋণ দেওয়া শুরু করলেন। ১৯৮৩ সালের ২রা অক্টোবর তার এই প্রকল্প পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। যার নাম হলো 'গ্রামীণ ব্যাংক'। গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও গত কয়েক দশকে মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদানসহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন।

গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়।

অধ্যাপক ইউনূসের অর্জিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, সিডনি শান্তি পুরস্কার। আর বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৭৮), কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৫) এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮৭)। ইউনুস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও অনেক পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।