ডলার সংকট: বিপিসির জ্বালানি সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা
জ্বালানি পরিবহন ভাড়া পরিশোধে বিএসসিকে তিন জাহাজ মালিকের লিগ্যাল নোটিশ, তিন জাহাজের ফ্রেইট পরিশোধে পর্যাপ্ত ডলার নেই বিএসসির, ১৩ মিলিয়ন ডলার বাজার থেকে কিনতে বিনিময় হারের অতিরিক্ত খরচের সম্মতি চেয়ে বিপিসিকে চিঠি
প্রথম নিউজ, চট্টগ্রাম: গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট প্রকট। আমদানি-রপ্তানিতে যা ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ডলার সংকটে আমদানি পণ্য ও সেবার বিল পরিশোধেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সংকট। এবার জ্বালানি তেল আমদানির জাহাজ ভাড়া পরিশোধেও সংকট তৈরি হয়েছে। নভেম্বর মাসে নির্ধারিত সময়ে ক্রুড অয়েলবাহী তিনটি বড় জাহাজের প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার ফ্রেইট পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় জাহাজ তিনটির মালিকপক্ষ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে (বিএসসি) লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি সাপ্লাই চেইনে ধসের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী বিপিসির আমদানি করা জ্বালানি পরিবহন করে বিএসসি। তারা দেশি মুদ্রায় বিল নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি জাহাজের ফ্রেইট (জাহাজ ভাড়া) দেয়। ডলার সংকটে পড়ে বিএসসি গত দুই মাসে ক্রুড অয়েলবাহী তিনটি জাহাজের এক কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৪ ডলার ৬৮ সেন্ট ফ্রেইট পরিশোধে ব্যর্থ হয়। এতে সংকট সমাধানে বিপিসির দ্বারস্থ হয়েছে বিএসসি।
জানা যায়, চলতি বছরের ১ অক্টোবর সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেবেল আলী বন্দর থেকে ৯৮ হাজার ১৪৩ মেট্রিক টন মারবান ক্রুড চট্টগ্রামে নিয়ে আসে ‘এমটি ওমেরা লিগ্যাসি’। গত ৪ নভেম্বর সৌদি আরবের রাস আল খাইর বন্দর থেকে ৯৯ হাজার ৮৬২ টন অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড নিয়ে আসে ‘এমটি ডাফনি’ এবং ৯ নভেম্বর একই বন্দর থেকে ৮১ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড নিয়ে আসে ‘এমটি গামসুনুরু’।
জাহাজগুলো যথানিয়মে খালাসের পর নির্ধারিত সময়ে ফ্রেইট পরিশোধে ব্যর্থ হয় বিএসসি। এর মধ্যে এমটি ওমেরা লিগ্যাসির ফ্রেইট ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ২০৪ ডলার ৭৭ সেন্ট, এমটি ডাফনির ৪৬ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৫ ডলার ৭২ সেন্ট এবং এমটি গামসুনুরুর ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪ ডলার ১৯ সেন্ট পাওনা হয়। কিন্তু ডলার সংস্থান করতে না পারায় নির্ধারিত সময়ে ফ্রেইট পরিশোধে ব্যর্থ হয় বিএসসি। অন্যদিকে নির্ধারিত ফ্রেইট না পেয়ে গত ১১ ডিসেম্বর বিএসসিকে লিগ্যাল নোটিশ দেয় জাহাজ তিনটির মালিক প্রতিষ্ঠান। এতে বিপাকে পড়ে বিএসসি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংক থেকে ডলার সংস্থান করতে না পারলে স্থানীয় ডলার মার্কেট থেকে কিনে জাহাজ সরবরাহকারীদের ফ্রেইট পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত রেট অনুযায়ী প্রতি ডলার ১১০ টাকা। কিন্তু ডলার মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৬-১২৭ টাকা। তবে ব্যাংক রেট এবং মার্কেট ফরোয়ার্ড রেটের মধ্যে প্রায় ১৭ টাকার মতো ব্যবধান। ডলার মার্কেট থেকে এক কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৪ ডলার ৬৮ সেন্ট ২২ কোটি ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকার বেশি অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে বিএসসিকে। ডলার সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত টাকা ব্যয়ের বিষয়ে বিএসসি সম্মতি চায় বিপিসির।
এ নিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর বিপিসি চেয়ারম্যানকে দেওয়া বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মো. জিয়াউল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বিপিসির পক্ষে বিএসসি প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টন ধারণক্ষমতার মাদার ট্যাংকার জাহাজ ভাড়া করে ক্রুড অয়েল পরিবহন করে আসছে। বিপিসি ওই মাদার ট্যাংকার জাহাজের ভাড়া স্থানীয় মুদ্রায় (টাকা) বিএসসিকে পরিশোধ করে। এরপর বিএসসি ইউএস ডলারে বিদেশি জাহাজ মালিককে ফ্রেইট পরিশোধ করে। মূলত বিএসসির নিজস্ব জাহাজ পরিচালনার আয় থেকে পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ডলার তহবিল থেকে বিপিসির মাদার ট্যাংকার জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করা হয়।
সরবরাহকারী জাহাজ না দিলে সামনের দিকে আমরা অন্য স্থান থেকে জাহাজ ভাড়া করে ক্রুড নিয়ে আসবো। এখন আমরা বিপিসিকে চিঠি দিয়েছি। তারা মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি অনুমোদন নিতে কিছু সময় লাগতে পারে। এরপর হয়তো তারা আমাদের জানাবে। এতে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেবো।- বিএসসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মো. জিয়াউল হক
২০২৩ সালে বিপিসির ৯টি মাদার ট্যাংকার জাহাজের ফ্রেইট হিসেবে ৪০ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বিএসসি। বর্তমানে বিএসসির তহবিলে পর্যাপ্ত ইউএস ডলার নেই। অন্যদিকে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে বিএসসির বহরের তিনটি জাহাজ বিদেশের বন্দরে ড্রাইডকিং অবস্থায় রয়েছে। এসব জাহাজের জন্য প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে বিপিসির ক্রুড অয়েল বহনকারী তিনটি জাহাজের ভাড়া পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সংস্থানের জন্য ২৭ নভেম্বর অগ্রণী ব্যাংককে অ্যাডভাইস দেয় বিএসসি। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক ওই পরিমাণ ডলারের চাহিদা দিলেও এখনো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ফান্ড পায়নি।’
এদিকে ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাহাজ তিনটির ভাড়া পরিশোধ না হওয়ায় বৈদেশিক জাহাজ মালিক বিএসসিকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়। ফলে বৈদেশিক কিংবা দেশি বন্দরে বিপিসির চার্টার করা জাহাজ আটক হওয়াসহ ফিন্যান্সিয়াল হোল্ড আরোপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাহাজ তিনটির ভাড়া পরিশোধ করা না গেলে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়ে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি নিরাপত্তা সংকটে পড়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে’ বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বর্ণিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৯-০৫-২০২৩ তারিখের সার্কুলার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকস ট্রানজেকশন্স উইথ এডিস এর সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান এবং সোনালী ব্যাংকের ১২-০৪-২০২২ তারিখের সার্কুলারের আলোকে পেট্রোবাংলার অনুরূপ প্রক্রিয়ায় মার্কেট রেট কিংবা ফরোয়ার্ড রেট- এ ডলার ক্রয়পূর্বক জাহাজ ভাড়া পরিশোধের শর্তে বিপিসি কর্তৃপক্ষের সম্মতি পাওয়া গেলে যথাসময়ে ইউএস ডলারে জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করা যেতে পারে।’
বিপিসিকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘সরবরাহকারী জাহাজ না দিলে সামনের দিকে আমরা অন্য স্থান থেকে জাহাজ ভাড়া করে ক্রুড নিয়ে আসবো। এখন আমরা বিপিসিকে চিঠি দিয়েছি। তারা মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি অনুমোদন নিতে কিছু সময় লাগতে পারে। এরপর হয়তো তারা আমাদের জানাবে। এতে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেবো। তবে এ বিষয়ে জানতে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের মোবাইলফোনে অসংখ্যবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্য জানতে হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি।
পরে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে গত ২১ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে চেয়ারম্যানের অফিসিয়াল মেইলে মেইল করা হয়। এতেও বিপিসির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি জানতে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহম্মেদকেও একাধিকবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে বক্তব্য জানতে চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।