ডনাল্ড লু আসছেন আজ

তার সফরে ব্যবসা-বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, নাগরিক অধিকারসহ দুই দেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা হবে।

ডনাল্ড লু আসছেন আজ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের  সম্পর্কের বিষয়টি দেখভালে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী ডনাল্ড লু আসছেন আজ। তার সফরে ব্যবসা-বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, নাগরিক অধিকারসহ দুই দেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা হবে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, মঙ্গলবার দিনের শুরুতে কলম্বো থেকে ঢাকা পৌঁছাবেন লু। তার সফরটিকে ঘিরে এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই ক’দিন তার সফর নিয়ে খোলাখুলি কথা বলছেন। বিরোধী দলের নেতারা অবশ্য এ নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন। তারা খুব একটা উচ্ছ্বাস না দেখালেও সফরটি যে পর্যবেক্ষণে রয়েছে তা বিরোধী নেতাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট।

একটি সূত্র অবশ্য বলছে, লু’র এবারের সফরে র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টিতে জোর দেবে বাংলাদেশ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বরে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেটি প্রত্যাহারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে র‌্যাবের কার্যক্রম তথা অপারেশনে ‘ইতিবাচক’ অনেক পরিবর্তন এসেছে। যা লু’র সফরে উপস্থাপন করে ওয়াশিংটনের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করবে ঢাকা।

সেগুনবাগিচা বলছে, গত ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। প্রস্তাবিত সূচি মতে, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু ঢাকা সফরের প্রথম দিন (আজ) রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দেয়া এক নৈশভোজে যোগ দেবেন। সফরের দ্বিতীয় দিন (কাল) তিনি প্রথমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ও পরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। তিন দিনের ঢাকা সফরের সময় ডনাল্ড লু’র নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে। 

লু’র সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা স্পষ্ট করেছেন। ওই চিঠির শুরুতে বাইডেন ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্ব’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন; যা থেকে স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগ দিচ্ছে। আর অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হিসেবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা; অর্থনৈতিক উন্নয়ন; জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি; বৈশ্বিক স্বাস্থ্য; মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। 

সঙ্গত কারণেই লু’র সফরে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় অন্য ইস্যুগুলোও আসবে। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকারসহ সামগ্রিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান উপাদান উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন বিষয়গুলো আলোচনা থেকে হারিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিকে বিবেচনায় হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বিষয়গুলোকে এখনই সামনে আনবে না। উদাহরণ টেনে ওই কর্মকর্তা বলেন, লু’র বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতেও প্রসঙ্গগুলোর উল্লেখ নেই। সেগুনবাগিচার অন্য এক কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার পর্বে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার সুরক্ষার বিষয়টিতে জোর দিতে পারে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক এইলিন লউবেচার। তার সফরসঙ্গী হিসেবে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। গত মাসে বাংলাদেশ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন টিকফা ফোরামের বৈঠকের পাশাপাশি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠকে শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন ব্যবসা ও বিনিয়োগে জোর দিচ্ছে, সেখানে শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়ন অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনায় থাকবে বলে ঢাকার কর্মকর্তাদের মত।

ডনাল্ড লু’র সফর ঘিরে যে কারণে বাংলাদেশে আগ্রহ: ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের স্বতন্ত্র অবস্থান ছিল, যা এখনো বিদ্যমান। নির্বাচন প্রশ্নে স্বতন্ত্র অবস্থান সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বহুমাত্রিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার। সঙ্গে মার্কিন আরও দুই কর্মকর্তা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে প্রথম সফর। কর্মকর্তাদের মতে, নানা কারণে সাউথ এশিয়ায় আলোচিত ডনাল্ড লু’র ঢাকায় এটি হবে ৪র্থ সফর। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতে বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণাসহ নানামুখী তৎপরতার পার্ট হিসেবে গত জুলাইতে তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সফরসঙ্গী হয়ে এসেছিলেন তিনি। ভোট-পূর্ব রাজনীতিতে বাড়তি উত্তাপ থাকায় উজরা জেয়া ও ডনাল্ড লু’র  যুগল সফরটি কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলে ছিল। ফলে এটি দেশ ও দেশের বাইরে বেশ আলোচনায় ছিল। উজরা জেয়া ও ডনাল্ড লু সেদিন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করেছিলেন।

নির্বাচন কোন ফর্মে হবে তা নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো চাওয়া নেই, সেটি তাদের সফরে স্পষ্ট করা হয়েছিল। মূলত বিষয়টি বাংলাদেশের নেতৃত্বের ওপর ছেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই তো শিরোনাম হয়েছিল- ‘বাংলাদেশের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে বিমানে উঠলেন উজরা’। আলোচিত সেই সফরে প্রভাবশালী মার্কিন কর্মকর্তাদ্বয় খোলাসা করেই বলেছিলেন, ‘আসুন বাংলাদেশের মানুষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিই।’ ঢাকা সফরের পর গত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে শর্তহীন সংলাপের জন্য চিঠি দেন ডনাল্ড লু। কিন্তু সেই আহ্বানে কাজ হয়নি। সংলাপ তো নয়ই, বরং আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ফের ক্ষমতায় এসেছে। ফলে নির্বাচনের পর ডনাল্ড লু বাংলাদেশে এসে কী বলেন তাতেই দৃষ্টি রাজনীতি সচেতনদের। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. শহীদুল হক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে  বেশি জোর দিচ্ছে। তারা রাখাইন এস্টেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে জোর দিচ্ছে।

বাংলাদেশকে হয়তো তারা এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি যুক্ত করতে চাইবে। ডনাল্ড লু’র সফরের গুরুত্ব সেই দিকেই বলে আমার মনে হয়। এখন তারা ভূ-রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তাদের যে কমন স্ট্যান্ড গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার সেই বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণভাবে কথা বলবে। তবে এর আগে হওয়া বেশ কিছু আলোচনার ফলোআপও তারা জানতে চাইবে।  কয়েক মাস আগে বড় একটা ডেলিগেট এসেছিল। তার ফলোআপ হতে পারে।” তার কথায়, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তো জানা। নির্বাচনের পর তো স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিবৃতি দিয়ে অবস্থান জানিয়েছে।  সেখানে তারা সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার কথাও বলেছে। সাবেক কূটনীতিকের কথায়, ‘তাদের এখন হয়তো মনোযোগ অর্থনৈতিক দিকে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনীতি নিয়ে তারা বলেই যাবে। আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন- নির্বাচনের আগে বিএনপি’র নয়াপল্টনের সমাবেশ ঘিরে সহিংস ঘটনার আগ পর্যন্ত তো যুক্তরাষ্ট্র উচ্চকণ্ঠ ছিল।  তার পর থেকে তাদের ভয়েস ডাউন হয়ে যায়। এখন তারা অন্য কোনো পদ্ধতিতে এগোচ্ছে তা এখনো অজানা। তবে তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র সব কিছু হজম করে ফেলবে। এখানে ভারতকে একতরফা সব করতে দেবে বলে মনে করেন না তিনি। ডয়চে ভেলেকে ওই কূটনীতিক বলেন, ‘ইন্ডিয়াকে তারা এতটা পথ করে দেবে বলে আমি মনে করি না।’ পোড় খাওয়া ওই কূটনীতিক মনে করেন-  ডনাল্ড লু’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যে আলোচনা হবে তাতে রাজনীতিও থাকবে। কারণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যেই রাজনীতি আছে। তার মতে, রাজনীতি নিয়ে কী আলোচনা হলো তা প্রকাশ করা হলেও তো জানা যাবেই, এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করা হলেও তা জানা যাবে।