গাজীপুরে একের পর এক আচরণবিধি ভঙ্গ

গাজীপুরে একের পর এক আচরণবিধি ভঙ্গ

প্রথম নিউজ,গাজীপুর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের আচরণবিধি ভঙ্গের যেন প্রতিযোগিতা চলছে। শুক্রবার ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আলমাছ মোল্লা মায়ের নামে দোয়া মাহফিলের আড়ালে নির্বাচনি প্রচার সভার আয়োজন করেন।
বিশাল প্যান্ডেল ও মঞ্চ বানিয়ে গরু জবাই করে খাওয়া-দাওয়ায় আয়োজন করেন। মহানগরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পলিথিনে মোড়ানো এবং লেমিনেটিং করা শত শত পোস্টার ঝুলতে দেখা গেছে। সাঁটানো রয়েছে পাড়া-মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে। এসব বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে একের পর এক অভিযোগ যাচ্ছে। অন্যদিকে ছুটির দিনে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণাও ছিল জমজমাট। 
বৃহস্পতিবার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। জায়েদা খাতুন শুক্রবার নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি টেবিল ঘড়ি প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর নিজের ছবির সঙ্গে ছেলে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের নাম ও ছবি পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিলে ব্যবহার করেছেন। জায়েদা খাতুনের পক্ষে তার ছেলে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম নিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত জবাব পৌঁছে দেন।

জবাবে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিলে আমার ছবির সঙ্গে ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের ছবি ব্যবহার করার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এগুলো প্রিন্টিং মেশিনে ছাপানোর সময় আমি দেখার আগেই কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি, স্বার্থান্বেষী মহল তা বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করেছেন। তাদের অনুরোধ করব, দ্রুত ওইসব ছবি, পোস্টার, হ্যান্ডবিল সরিয়ে নিন। বিষয়টির জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’ ভবিষ্যতে আরও বেশি সতর্ক থেকে নির্বাচনি আইন মেনে চলবেন বলেও লিখিত জবাবে জানান জায়েদা খাতুন। 

শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ও সদর মেট্রো থানা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক মো. আলমাছ মোল্লা মঞ্চ ও বিশাল প্যান্ডেল বানিয়ে দোয়া মাহফিলের অন্তরালে নির্বাচনি প্রচার সভার আয়োজন করেছেন। তৈরি করেন তোরণ।

মঞ্চে সাঁটানো হয় ঠেলাগাড়ির ব্যানার। গরু জবাই করে ভোটারসহ কয়েকশ অতিথির ভূরিভোজের ব্যবস্থা করেন তিনি। এ নিয়ে অভিযোগ আসে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে। অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে এক কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে এসব বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এরপর ঠেলাগাড়ি প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী আলমাছ মোল্লা ছুটে আসেন রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে। পরে সন্তোষজনক সাড়া না পেয়ে তিনি কার্যালয় ত্যাগ করেন। 

নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী গেট, তোরণ, ঘের নির্মাণ, প্যান্ডেল বা ক্যাম্প স্থাপন ও আলোকসজ্জা করে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এছাড়া এদিন নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, পলিথিনে মোড়ানো ও লেমিনেটিং করা পোস্টারে ছেয়ে গেছে পাড়া-মহল্লার অলিগলি। পোস্টার সাঁটানো হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে। এটিও আচরণবিধির লঙ্ঘন। 

এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনি আচরণবিধি মানাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কমিশন। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের জন্য অফিসার পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো প্রার্থী যদি সতর্ক নোটিশ করার পরও একই অপরাধ করে তবে তাকে দুটি নোটিশ দেওয়া হবে। তার পরও যদি একই অপরাধ করে তবে কোনো ছাড় নয়, তার প্রার্থিতা বাতিলের প্রস্তাব নির্বাচন অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

প্রার্থীদের বিরামহীন প্রচারণা : শুক্রবার ছুটির দিনে বিরামহীন প্রচারণা চালিয়েছেন প্রার্থীরা। ছুটে বেড়িয়েছেন এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায়। দিয়েছেন উন্নয়নের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি। পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করেছেন ভিন্ন ভিন্ন মসজিদে। নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে দলবদ্ধভাবে হেঁটে গণসংযোগকালে লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি চলেছে মাইকিংও। 

এদিকে বিভিন্ন পথসভায় বক্তৃতাকালে আলোচিত স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী টেবিল ঘড়ি প্রতীকের জায়েদা খাতুন ও হাতি প্রতীকের প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে নানা ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করছেন। একইভাবে আজমত উল্লা খানও প্রতিদ্বন্দ্বী জায়েদা খাতুনের পুত্র সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরছেন এবং অপর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রনিকেও নির্বাচনি মাঠে বিভিন্নভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন।

নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান গাজীপুর সিটির প্রত্যন্ত ভাদাম এলাকার একটি জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। নামাজের আগে মুসল্লিদের দোয়া ও সমর্থন কামনা করে বক্তব্য রাখেন। এরপর ৫১, ৫২ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও নির্ধরিত পথসভায় বক্তব্য দেন। 

বক্তব্যে তিনি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এসব টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার হলে নগরীর কোনো সমস্যা থাকত না। তিনি বলেন, আমি টানা ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার দায়িত্বে ছিলাম। এর পর আরও ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে এতদিনে আঠারো টাকারও দুর্নীতির অভিযোগও আনতে পারেনি। অথচ বিগত দিনে এই সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। উচ্চ আদালতও এসব দুর্নীতি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ও তার ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী পথসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে একজন ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। আজমত উল্লা খানের ষড়যন্ত্রের কারণেই জাহাঙ্গীরকে দল ও মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে তারা বারবার অভিযোগ করে আসছেন। 

অন্যদিকে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনির বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সরকারকে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রকারী হিসাবেও আজমত উল্লা খানকে দায়ী করে তাদেরকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। আজমত উল্লা খান ওই মামলার সাক্ষীদের রিহার্সাল করে নূরুল ইসলাম সরকারকে হুকুমের আসামি হিসাবে ফাঁসিয়েছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন শুক্রবার বাদ জুমা নগরীর সালনা কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে প্রচারণা শুরু করেন। এর আগে তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম মসজিদে বক্তৃতায় মায়ের প্রতি মুসল্লিদের সমর্থন ও দোয়া কামনা করেন। পরে তারা তেলিপাড়া ও গাছাসহ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গণসংযোগ ও পথসভা করেন। 

পথসভায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি গত তিন বছর সিটি করপোরেশনে দায়িত্ব পালন করেছি। বাকি সময়টুকু আমাকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। তারই প্রতিবাদে আমার মা দেখেছেন, ১৮ মাস তার সন্তানের ওপর কী নির্যাতন চালিয়েছে। সেজন্য মা সন্তানের পক্ষ নিয়েছেন, এই শহরের পক্ষ নিয়েছেন। এই গাজীপুরকে যাতে কেউ কলঙ্কিত করতে না পারে সেজন্য মা বলেছেন আমি নির্বাচন করি, গাজীপুরের মানুষের কাছে যাই, যেহেতু সারা জীবন মানুষের সেবা করেছি, বাকি জীবনটুকুও মানুষের সেবা করতে চাই। সেজন্য মেয়র প্রার্থী হয়েছি।’ 

জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রচারণা করেছেন শহরের সাহাপাড়া এলাকায়। তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন সাহাপাড়া জামে মসজিদে। দুপুরের পর থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনি দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করেছেন কাশিমপুরের সুলতান মার্কেট এলাকায়। সন্ধ্যায় তিনি কোনাবাড়ি থানার জাতীয় পার্টি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাসন থানার কড্ডা বাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন। রাতে টঙ্গীর ৪৪নম্বর ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনি অফিস উদ্বোধন করেন এবং ওই এলাকায় গণসংযোগ করেছেন।

হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি সকাল ১০টা থেকে জুমাপূর্ব টঙ্গী পূর্ব থানার স্টেশন রোড, নতুন বাজার, ব্যাংকের মাঠ, রেলওয়ে জংশন গোল চত্বর, নোয়াগাঁও, তিস্তার গেট, ফাইসন্স রোড ও চেরাগ আলী এলাকায় গণসংযোগ করেন। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন এবং মসুল্লিদের সমর্থন ও দোয়া কামনা করে বক্তব্য রাখেন। পরে তিনি টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকায় গণসংযাগ ও স্থানীয় সাতাইশ চৌরাস্তায় পথসভা করেন।