অফশোর ব্যাংকিংয়ে কর অব্যাহতিতে এনবিআরের নারাজি

ডলার সংকট কাটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ জোরদার করতে এমন সুযোগ রেখে দেশে প্রথমবারের মতো ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

অফশোর ব্যাংকিংয়ে কর অব্যাহতিতে এনবিআরের নারাজি

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা হবে না। পাশাপাশি আমানতকারীদের অর্জিত আয়ের ওপরও থাকবে না কোনো কর বা শুল্ক। ডলার সংকট কাটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ জোরদার করতে এমন সুযোগ রেখে দেশে প্রথমবারের মতো ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪ ’-এর খসড়া তৈরি করে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের খসড়া যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠিয়েছে। কমিটির পর্যবেক্ষণের পর তা আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ফিরে আসবে। এরপর মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য পাঠাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নতুন আইনের খসড়া প্রণয়নের আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অংশীজনদের মত আমলে নেয়নি।

অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের অর্জিত মুনাফা বা সুদের ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপিত হবে না বলে যে বিধান যুক্ত হয়েছে, তা আয়কর আইন-২০২৩ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এখন আইনটির খসড়ার ওপর স্টেকহোল্ডারদের মতামত চাওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, খসড়া অনুমোদনের আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত যৌথ পরামর্শ সভায় আয়কর সংক্রান্ত প্রস্তাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিনিধি কর ও শুল্ক ছাড়ের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই আপত্তি শুধু মতামত হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে, আমলে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীসময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে এনবিআরের কাছে খসড়া আইনের ‘কর ও শুল্ক হইতে অব্যাহতি’ সংক্রান্ত ধারার বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। এরপর এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের পক্ষ থেকে মতামত পাঠানো হয়েছে।

মতামতে আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ৭৬ এর উপ-ধারা (২) উল্লেখ করে এনবিআর জানায়, ‘অন্য কোনো আইনে কোনো প্রকার কর অব্যাহতি প্রদান করা হলে সেই কর অব্যাহতি ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এনবিআর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অব্যাহতি-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।’ এ আইন অগ্রাহ্য করার কোনো আইনি সুযোগ নেই বলে এনবিআরের মতামতে জানানো হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়কে আরও জানানো হয়, নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, আয়কর আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইনগত দলিলের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি প্রদান করা হলে অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণিকে অব্যাহতি প্রদান না করলে তা কার্যকর হবে না।

প্রস্তাবিত খসড়া আইনের দফা ১৩ (ক)-তে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না। আইনের এ ধারার সঙ্গে একমত পোষণ করে না এনবিআর।

এনবিআরের মতামতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এ ধরনের আইনি বিধানের প্রস্তাব রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিদ্যমান করভিত্তি দুর্বল করবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিদ্যমান আইন অনুসারে করযোগ্য। বাংলাদেশের সব ব্যাংক তাদের অফশোর ইউনিট সহকারে এ যাবতকাল পর্যন্ত কর পরিশোধ করে আসছে। আকস্মিকভাবে এ ধরনের কর অব্যাহতি রাজস্ব আহরণকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

মতামতে এনবিআর কর্তৃক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি সাপেক্ষে ‘অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের প্রদেয় সুদ বা মুনাফা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করমুক্ত থাকবে’ অংশটি প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করা হয়েছে।

এর আগে অফশোর আইনের খসড়ায় বলা হয়েছিল, ‘আপতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন-অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের প্রদেয় সুদ বা মুনাফার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না।’

অফশোর ব্যাংকিং কী?

অফশোর ব্যাংকিং দেশে কার্যরত ব্যাংকের আলাদা ইউনিট। শুধু দেশের বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার জন্য ১৯৮৫ সালে এক আদেশে এ ইউনিট গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল মুনাফায়। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন ব্যাংকে অফশোর ব্যাংক ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে ওই নীতিমালা জরিমানা ও শাস্তির বিধানটি দুর্বল ছিল। এখন পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বর্তমান নীতিমালায় দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকা সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে পারবে। এক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ ও আমানত নিতে পারবে; কিন্তু যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে। ২০১৯ সালের আগে নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনা করেছে। এর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক অর্থপাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের পরে প্রতিটি ব্যাংককে একটি নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এখন একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা  বলেন, আয়কর আইনে কর অব্যাহতির বিষয়টি স্পষ্ট। কর অব্যাহতি কে পাবে, কে পাবে না; তা আইনেই বলা আছে। আয়কর আইনের মাধ্যমে কর অব্যাহতি প্রদান করা যায়। অন্য কোনো আইন দিয়ে কর অব্যাহতির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, আইনে পরিণত হওয়ার আগে যৌথ পরামর্শ সভা ছাড়াও স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে মিটিং হবে। সেখানে যার যা মতামত তা দেবে। পরবর্তীসময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। একটা আইন পাস হতে গেলে সব স্টেকহোল্ডারের পরামর্শ লাগে। তারপরই নির্ধারিত হবে কোনটা কীভাবে হবে। সভায় এনবিআরসহ অন্য প্রতিনিধিরা থাকবেন।

তিনি আরও বলেন, এর আগে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়ার পর কর অব্যাহতি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। পেনশন স্কিমের আইন অনুযায়ী, স্কিমের টাকা কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। তবে আয়কর আইনের ক্ষমতাবলে যেসব খাত অব্যাহতিপ্রাপ্ত, সেই তালিকায় ছিল না সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পরে এনবিআর এসআরও জারি করে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে অব্যাহতি প্রদান করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রস্তাবিত অফশোর আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এছাড়া ওই ইউনিটের আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের হিসাবের ওপর শুল্ক ও লেভি আরোপ করা হবে না। খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট আইনের ব্যত্যয় ঘটালে সে প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ২ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা জরিমানা আরোপ করা হবে। আইনের বিধান লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রথম দিনের পর দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতিদিনের জন্য ১০০ মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ দেশীয় মুদ্রা জরিমানা আরোপ করা হবে।

খসড়া আইনের বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, তফসিলি ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যক্তি অফশোর ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে না। লাইসেন্স পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে অফশোর ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল হবে। বাতিল বা স্থগিতের পর এর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। লাইসেন্স ছাড়া অফশোর ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। লাইসেন্সের শর্ত পালন না করা এবং অফশোর ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করলে বাতিল হবে লাইসেন্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে স্বেচ্ছায় লাইসেন্স সমর্পণ করতে পারবে।

অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, আইনে নির্দেশিত লেনদেন ছাড়া অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফান্ডেড বা নন-ফান্ডেড ব্যাংকিং লেনদেনে জড়িত হওয়া যাবে না; অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের নামে আমানতকারী দ্বারা উত্তোলিত চেক, ড্রাফট, পে-অর্ডার বা অন্য কোনো দলিলের বিপরীতে চাহিদার ভিত্তিতে পরিশোধযোগ্য আমানত বা ঋণগ্রহণ করা যাবে না এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ বা বিশেষ অনুমোদন ছাড়া অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে তহবিল স্থানান্তর করা যাবে না। এছাড়া ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ঋণসুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।