সমকামিতার অভিযোগ মিথ্যা টাকা লুটে নিতে পরিকল্পিতভাবে সাবেক শিক্ষক গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: নগদ টাকা হাতিয়ে নিতেই পরিকল্পিতভাবে ঢাকার সাভারের সাবেক শিক্ষক গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ইমনসহ জড়িত তিনজনকে যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর এতথ্য জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের পর লুট করা ৫ লক্ষাধিক টাকা।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২০ আগস্ট আনুমানিক বিকেল ৩টার দিকে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কক্ষ থেকে হাত-পা বাঁধা এবং গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় গোলাম কিবরিয়া (৪৩) নামে সাবেক এক স্কুল শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ সময় মরদেহের পাশ থেকে 'এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি, ভাই ও অবৈধ কাজ করে........আমরা ইসলামের সৈনিক' লেখা সম্বলিত একটি চিরকুট পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে সাভার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং-৬২/৬৬৯। র্যাব এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, সোমবার রাতে র্যাব-৪, ৬ ও ১৩ এর দল যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. ইমন খান (২৩), মো. সাগর (২২) ও তাদের সহযোগী ছাদেক গাজীকে (২২) গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা ভিকটিম গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, ভিকটিম গোলাম কিবরিয়া সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিগত কয়েক বছর ধরে নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। পাশাপাশি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন।
গত ১৯ আগস্ট রাত ১০টার সময় তার বড় ভাই গোলাম মোস্তফার ঘরে রাতের খাবার শেষে নিজ কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘটনার দিন ২০ আগস্ট দুপুর ২টার সময় ঘুম থেকে না ওঠায় ভিকটিমের বাড়ির লোকজন তাকে ডাকাডাকি করে। একপর্যায়ে ভিকটিমের ঘরের পেছনের দরজা খোলা দেখতে পায়। এ সময় ভিকটিমের বাড়ির লোকজন রুমের ভেতরে গিয়ে খাটের ওপর লুঙ্গি দিয়ে ভিকটিমের হাত-পা বাধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় ভিকটিমের নিথর দেহ দেখতে পায়। এছাড়াও ভিকটিমের রুমের মালামাল এলোমেলো এবং আলমারি খোলা অবস্থায় ছিল।
হত্যার নেপথ্যের কারণ বিবরণ দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, গ্রেপ্তার ইমনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। গ্রেপ্তার সাগর একজন অটোরিকশা চালক হওয়ায় ভিকটিম তার অটোরিকশায় মাঝে মধ্যে যাতায়াত করার কারণে ২ বছর আগে ভিকটিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। পরে গত ৬ মাস আগে গ্রেপ্তার সাগর তার বন্ধু ইমনকে ভিকটিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
পরিচয়ের সুবাদে ইমন ও সাগর ভিকটিমের বাসায় মাঝে মধ্যে যাওয়া আসা করতো। ভিকটিম গোলাম কিবরিয়া জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন এবং ব্যবসার যাবতীয় টাকা বাসায় রাখতেন। গ্রেপ্তার সাগর ও ইমন ভিকটিমের বাসায় যাওয়া আসার সুবাদে ভিকটিমের আলমারিতে রাখা জমি ক্রয়-বিক্রয়ের বিপুল পরিমাণ টাকা তাদের নজরে আসে। পরে ইমন ও সাগর গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করে তার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে।
গ্রেপ্তার ইমন পরিকল্পনার বিষয়টি ঘটনার ৭-৮ দিন আগে তার বন্ধু ছাদেককে জানায়। বিভিন্ন জায়গায় ঋণ থাকায় নগদ টাকা প্রাপ্তির আশায় ছাদেকও এই পরিকল্পনায় সম্মতি দেয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন ১৯ আগস্ট ইমন ও ছাদেক জিরানী বাজার থেকে বাসে করে সাভারের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এসে ইমন ভুক্তভোগী সাবেক শিক্ষক গোলাম কিবরিয়াকে ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি বাসায় আসতে বলেন।
আনুমানিক রাত পৌনে ১১টার সময় ইমন ও ছাদেক ভিকটিমের বাসায় আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর অটোরিকশা নিয়ে বাসার আশেপাশে অবস্থান নেয়। তারা রাতে হালকা নাস্তা শেষে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ১১টার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে গ্রেপ্তার ছাদেক ভিকটিমের গলা চেপে ধরে এবং ইমন মুখ চেপে ধরে। লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য গ্রেপ্তার ছাদেক নিজ হাতে একটি সাদা কাগজে চিরকুট লিখে (এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি, ভাই ও অবৈধ কাজ করে, আমরা ইসলামের সৈনিক) মরদেহের পাশে রেখে দেয়।
ইমন ভিকটিমের বিছানার নিচ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন লুট করে। পরে তারা সাগরের অটোরিকশায় উঠে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চলে আসে। গ্রেপ্তার ইমন সাগরকে ৫০ হাজার টাকা দেয় এবং বাকি ৬ লাখ টাকা গ্রেপ্তার ইমন ও ছাদেক নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়।
ঘটনার পরের দিন সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে ইমন প্রথমে গাজীপুর পরে যশোরের চৌগাছা এলাকায়, সাগর রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকায় এবং ছাদেক ঝিনাইদহ এলাকায় তাদের নিকট আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় র্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার ইমন সম্পর্কে কমান্ডার মঈন জানান, বাবা-মাসহ প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকার জিরানী এলাকায় বসবাস করছিল ইমন। সে রাজধানীর আশুলিয়ার একটি কলেজ থেকে ২০২০ সালে এইচএসসি পাস করে। সে আশুলিয়ার জিরানী এলাকার একটি গার্মেন্টসে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করতো। মাদকাসক্ত ইমনের বিরুদ্ধে গাজীপুরের কাশিমপুর থানায় একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার সাগর বাবা-মাসহ প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকার জিরানী ও সাভার এলাকায় বসবাস করছে। সে জিরানী ও সাভার এলাকায় অটোরিকশা চালাতো। ২০১৯ সালে জিরানী এলাকায় বিশৃঙ্খলা, মাদক ব্যবসা ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার কারণে এলাকাবাসী তাকে ও তার পরিবারকে এলাকা থেকে বের করে দিলে সে পরিবারসহ সাভারে ওয়াবদা রোডে এসে বসবাস শুরু করে।
গ্রেপ্তার ছাদেক বাবা-মাসহ প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকার জিরানী এলাকায় বসবাস করছে। সে জিরানী বাজারে একটি গামেন্টসে চাকরি করতো। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।