শর্তসাপেক্ষে মুক্তি ৪ বছরে ৮ মাসই হাসপাতালে ছিলেন খালেদা জিয়া

 শর্তসাপেক্ষে মুক্তি ৪ বছরে ৮ মাসই হাসপাতালে ছিলেন খালেদা জিয়া

প্রথম নিউজ, ঢাকা : বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর গত চার বছরে আট মাসের বেশি সময় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে একই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শঙ্কা প্রকাশ করছেন দলটির নেতারাও।

বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে। প্রতিবারই তাকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, এটা উদ্বেগজনক। এবার ভর্তি করার পর তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে।

সামরিক অভ্যুত্থানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশের টালমাটাল পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরেছিলেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। গৃহবধূ হয়ে রাজনীতিতে আসা এই নেত্রী ধীরে ধীরে দল গুছিয়ে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ১৯৮৪ সালে হয়েছেন দলের চেয়ারপারসন। এরপর রাজনীতিতে তার সুদীর্ঘ পথচলা।

দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর আরও দুই দফা প্রধানমন্ত্রী হন। দুর্নীতির দায়ে দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এই নেত্রী এখন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির অবস্থাও অনেকটা বেসামাল।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাদণ্ড ভোগ করেন খালেদা জিয়া। এরপর ২০২০ সালে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভাই শামীম ইস্কান্দার মানবিক কারণে স্থায়ীভাবে মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। সে বছরের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে (বিদেশে যেতে পারবেন না ও ঢাকায় থেকে চিকিৎসা) মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। এরপর ছয় মাস পরপর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর গত চার বছরে খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন সময়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছে, দিনের হিসাবে যা প্রায় ২৬০ দিন (আট মাস ২০ দিন)। আর কারাবন্দির পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এভারকেয়ার হাসপাতাল- সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া দেড় বছরের বেশি সময় হাসপাতালে রয়েছেন। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই ভোর ৪টা ২০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেই থেকে তিনি হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে তার ভাই শামীম ইস্কান্দারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
৯ দফা হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া

শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল থেকে বাসায় ফেরেন। দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১১ মাস তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কারামুক্তির পর ৯ দফায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

করোনাভাইরাস ধরা পড়লে ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল প্রথম এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। চিকিৎসা শেষে ১৯ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে গুলশানের বাসায় ফিরে আসেন। এরপর ২০২২ সালের ১১ জুন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে মধ্যরাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৪ জুন হাসপাতাল থেকে বাসায় আসেন। ওই বছরের ২৮ আগস্ট একই হাসপাতালে আবার ভর্তি হন খালেদা জিয়া এবং ৩১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন।

এরপর ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৪ মে হাসপাতাল থেকে বাসায় আসেন খালেদা জিয়া। একই বছরের ১৩ জুন হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। ১৭ জুন বাসায় ফেরেন তিনি। এরপর ৯ আগস্ট ভর্তি হয়ে পাঁচ মাস দুদিন পর ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। আবারও ৩১ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২ এপ্রিল বাসায় ফেরেন তিনি। গত ২২ জুন রাত ৩টার দিকে আবার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া এবং ২ জুলাই বাসায় ফেরেন। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। সেই থেকে এখনও সিসিইউতে চিকিৎসাধীন তিনি।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, শর্তসাপেক্ষে কারা মুক্তির পর ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর খালেদা জিয়ার প্রথম সার্জারি হয়। এরপর ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর এভারকেয়ার হাসপাতালে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের তিন বিশেষজ্ঞ জেমস পিটার অ্যাডাম হ্যামিল্টন, হামিদ আহমেদ আবদুর রব ও ক্রিস্টোস জর্জিয়াডেস খালেদা জিয়ার যকৃতের রক্তনালীতে অস্ত্রোপচার করেন। পরবর্তীসময়ে চলতি বছরের ২৩ জুন খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার স্থাপন করা হয়।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসক এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ওই সময় বলেছিলেন, ‘পেসমেকার বসিয়ে সাময়িক একটা সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে যে ঝুঁকি, সেটা খুব একটা কমছে বলে আমরা মনে করছি না।’ তিনি আরও জানান, খালেদা জিয়া মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। যেটি তার শারীরিক পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে তুলেছে।

প্রায় ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগ তার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি বলে মনে করেন তার চিকিৎসকরা।

বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিচ্ছে না। দলের চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ পাঠানোর দাবিতে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রথম আট দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে ১৪ অক্টোবর সারাদেশে অনশন কর্মসূচি পালিত হয়। চলতি বছরের ২৯ জুন সর্বশেষ তিনদিনের কর্মসূচি পালন করে দলটি। সর্বশেষ ৯ জুলাই এক বিবৃতির মাধ্যমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার দাবিতে দলের পক্ষ থেকে শিগগির কর্মসূচি নেওয়া হবে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ পাঁচটি বিষয় সামনে রেখে চলতি সপ্তাহ থেকেই ‘সর্বাত্মক’ কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার পরপরই এ কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।