ভিসানীতি: পুলিশে মাঠ পর্যায়ে উদ্বেগ, ঊর্ধ্বতনরা বলছেন ‘নো টেনশন’
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি অংশ। যদিও তারা কেউই প্রকাশ্যে এটি স্বীকার করতে চাইছে না।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি অংশ। যদিও তারা কেউই প্রকাশ্যে এটি স্বীকার করতে চাইছে না। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। তবে দুই লাখের বেশি সদস্যের পুলিশ বাহিনীকে চাঙা রাখতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘নো টেনশন’। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির আওতায় কারা পড়বেন বা পড়েছেন, তা নিয়ে আছে নানান মত। যেহেতু দেশটি কোনো তালিকা হস্তান্তর করেনি সেহেতু যিনি নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন তারা ছাড়া জানার সুযোগ কম। পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসানীতি নিয়ে কর্মকর্তাদের এত চিন্তার কিছু নেই। যার যে দায়িত্ব, সেটা যথাযথভাবে পালন করলেই এ নিয়ে ভয় থাকার কথা নয়।
ইন্সপেক্টর থেকে নিচের পদবির পুলিশ সদস্যরা ভিসানীতি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায় না। তারা আমেরিকা যায় না। তাদের মধ্যে ০.১ শতাংশও আমেরিকা যায় না। কমান্ডিং লেভেলে যারা থাকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে হয়তো মানসিক চাপে থাকতে পারে। তবে সেটা তারা প্রকাশ করে না।-সাবেক আইজিপি শহীদুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির আওতায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী সরকারি-আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল, বিরোধীদলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি ভিসানীতি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। তারা বলছেন, ‘ভিসানীতি নিয়ে চিন্তিত নয় পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জানানোর পর যারা পুলিশের তালিকা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। একটি সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আসন্ন নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে দেশটি। কারও নাম উল্লেখ না করলেও ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা রয়েছেন। এরপর থেকেই মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। যারা নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে আসা-যাওয়া করছেন তারাই আছেন বেশি অস্থিরতার মধ্যে।
এই ভিসানীতি পুলিশের স্বাভাবিক কাজে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত শুনে আসছি ভিসানীতি নিয়ে কয়েকজন চিন্তায় আছেন। তবে বিষয়টা এখনো অন্ধকারে। কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ছেন, কোন ধরনের কাজের জন্য তালিকা করা হচ্ছে, এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার। এ নিয়ে সব কর্মকর্তার মধ্যে একধরনের চাপ বিরাজ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ডিআইজি, দুজন অতিরিক্ত ডিআইজি ও দুই জেলার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জাগো নিউজকে বলেন, ঊর্ধ্বতন স্যাররা বলছেন কোনো ভয় নেই, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছে তারা কিছুটা হলেও ভয়ে আছে। নির্বাচনের সময় কোন কাজটি ভুল আর কোন কাজটি করলে সঠিক হবে তা নির্ণয় করা অনেকটা কঠিন হবে। ভিসানীতি নিয়ে কেউ কেউ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
পুলিশের মাঠপর্যায়ের ইন্সপেক্টর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার সাতজন তারা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইনের মধ্যে থেকে মানবাধিকার সমন্বিত রেখে কাজ করলেও নির্বাচনের সময় মাঠে কাজ করা অনেক কঠিন। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বাস্তবতার সঙ্গে কাজ করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। আর কাজ করতে গেলে ভুল হবে এটিই স্বাভাবিক। এর জন্য দায়ী করে শাস্তি হিসেবে ভিসানীতি প্রয়োগ করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে পুলিশ কোনো চিন্তা করে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নবনিযুক্ত কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমি নির্বিঘ্নে বলতে চাই, একটি দেশের ভিসানীতি কী হবে এটি তাদের বিষয়। এটি নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের চিন্তার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা মনে করি পুলিশ বাহিনী আইনের মধ্যে থেকে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে কাজ করে। এর আগেও করেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকবে। সুতরাং, এই ভিসানীতির কারণে আমাদের কাজের গতি কোনোভাবেই থেমে যাবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।- ডিএমপি মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের প্রধান উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন
সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ভিসানীতি নিয়ে পুলিশে ইমেজ সংকট হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে সবই অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে অন্তর্ভুক্তদের তালিকা আপনারা পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা এ ধরনের তালিকা পাইনি। আমাদের কাছে কোনো নাম আসেনি। যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো মনে হয় সবই অতিরঞ্জিত, সত্যি ঘটনা নয় এগুলো।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা চলমান। তাই বিষয়টি (ভিসানীতি) নতুন নয়। আমরা মনে করি র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত সমাজ গঠনে কাজ করছে। আমরা আগের মতোই কাজ করে যাচ্ছি। ভিসানীতি সুনির্দিষ্ট একটি দেশের বিষয়। তারা তাদের বিবেচনায় কাজ করছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। র্যাব ভিসানীতি নিয়ে ভাবছে না। আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছি।’
ডিএমপি মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের প্রধান উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি আসবে তারা হয়তো আমেরিকা যেতে পারবেন না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের দুই লাখেরও বেশি সদস্য রয়েছেন। এই পুলিশ সদস্যদের মধ্য থেকে কতজন আমেরিকা যাচ্ছেন? খুবই নগণ্য কিছু লোক হয়তো আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন অথবা তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠানোর চিন্তা করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন ভিসানীতিতে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী যেভাবে কাজ করে, তাদের কাজের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।’
ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি পুলিশ বাহিনী আইনের মধ্যে থেকে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে কাজ করে। এর আগেও করেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকবে। সুতরাং, এই ভিসানীতির কারণে আমাদের কাজের গতি কোনোভাবেই থেমে যাবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘ডিএমপির মূল কাজ ঢাকা শহরে আড়াই কোটি মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা। আমাদের মূল ফোকাস অপরাধ নির্মূল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। ভিসানীতি কিংবা অন্য যে কোনো নীতি নিয়ে আমাদের কোনো ফোকাস নেই। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ইন্সপেক্টর থেকে নিচের পদবির পুলিশ সদস্যরা ভিসানীতি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায় না। তারা আমেরিকা যায় না। তাদের মধ্যে ০.১ শতাংশও আমেরিকা যায় না। কমান্ডিং লেভেলে যারা থাকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে হয়তো মানসিক চাপে থাকতে পারে। তবে সেটা তারা প্রকাশ করে না।’