ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের অনুমোদনে ভোগান্তি বাড়বে বহুগুণ
ফাইল আটকে থাকবে মাসের পর মাস। আর্থিক অনিয়মও হবে ভয়াবহ।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ভবন নির্মাণে রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নিতে হলে গ্রাহক ভোগান্তি বাড়বে বহুগুণ। ফাইল আটকে থাকবে মাসের পর মাস। আর্থিক অনিয়মও হবে ভয়াবহ। আজ শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব আয়োজিত ‘ভবন নির্মাণে রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিধানের প্রতিবাদ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে’ এসব শঙ্কার কথা জানান আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা।
সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাব সভাপতি শামসুল আলামিন কাজল, সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ, সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সোহেল রানাসহ রিহ্যাব নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলেন, ভবন নির্মাণে অনুমোদন নিতে গিয়ে অনেক সময় মাসের পর মাস ফাইল আটকে থাকে রাজউকে। এবার সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নিতে গেলে একই ভোগান্তি হবে দুই জায়গায়। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গ্রাহক। বিনিয়োগে বাধার মুখে পড়বেন ব্যবসায়ী।
সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজউক ৫০ বছরের অধিক সময় থেকে ঢাকায় ছোট-বড় সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে এবং তদারকি সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন রাজউক ও তার জনবল উক্ত কাজে একটি সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা লব্ধ সক্ষমতা অর্জনে সিটি করপোরেশন অদ্যাবধি নবীনতম বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান। সিটি করপোরেশনের তো এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জনবল নেই, কোনো কাঠামো নেই। ফলে ভোগান্তি বেড়ে যাবে আরও কয়েকগুণ।
তিনি বলেন, নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে অনুমোদনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন পেলে তাতে দ্বৈত প্রশাসনের সৃষ্টি হবে। এই সিদ্ধান্ত আসলেই সাংঘর্ষিক ও অবাঞ্ছিত। আমরা ভোগান্তি কমাতে রিহ্যাব থেকে দীর্ঘদিন ধরে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সেখানে আরও নতুন তদারকি সংস্থা যুক্ত করা হচ্ছে। যা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিবেচিত হবে। আবাসন খাত অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকে এই ধরনের প্রস্তাব বিনিয়োগবান্ধব নয়। দেশের বিদ্যমান আবাসন সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে আমরা আবাসন খাতের বিনিয়োগকে সহজ করার দাবি জানাই। আমরা সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে অর্ধশতকের অভিজ্ঞ রাজউককে পরিকল্পিত শহর গঠন ও তদারকির দায়িত্ব অব্যাহত রাখার দাবি জানাচ্ছি।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে পত্রিকা মারফত জানতে পারি, কেবল বহুতল ভবনই নয় যেকোনো ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে একই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কতবার অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এটা সর্বজনবিদিত যে, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জনগণের ভোগান্তি কমাতে চাচ্ছে। এজন্য অনেক কিছু ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রচলন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই রকম একটি ক্ষেত্রে এই জাতীয় সিদ্ধান্ত গৃহায়ন শিল্পের জন্য একটি গভীর ও নবতর সংকট সৃষ্টি করবে। সরকার যেখানে ইজি অব ডুইং বিজনেস করার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে সেই অবস্থায়, এই ধরনের সিদ্ধান্ত ইজি অব ডুইং বিজনেস পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যেটি আমাদের আরও শঙ্কিত করেছে সেটি হলো সিটি করপোরেশন অনুমোদিত স্থাপনা নিয়মিত মনিটরিং করার ব্যবস্থা রাখবে এবং যদি সিটি করপোরেশন মনে করে রাজউক অনুমোদিত অবকাঠামো শহরের জন্য কল্যাণকর নয় তাহলে সেই অবকাঠামোর কাজ বন্ধ করে দিতে পারবে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এই কল্যাণকর বা অকল্যাণকরের মাপকাঠি কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে এই প্রশ্নে আমরা শঙ্কিত ও আতঙ্কিত।
রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত সভায় প্রস্তাব আকারে সিদ্ধান্ত হয়, অবকাঠামো নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিতে হবে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরিপত্র বা সরকারি আদেশ জারি না হলেও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের কারণে গৃহায়ন শিল্প সংশ্লিষ্ট আমাদের মধ্যে গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের আগে ১০ তলার অধিক বহুতল ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র গ্রহণের একটি বিধান প্রচলিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে রাজউক কর্তৃক প্ল্যান পাসের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আগে অনুমোদন দেওয়া ১০/১১টি প্রতিষ্ঠান/সংস্থার পরিবর্তে তিনটি সংস্থা থেকে (রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল এভিয়েশন) অনুমোদন নেওয়ার সহজ প্রক্রিয়া প্রচলন করা হয়।
কামাল মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আবাসন ব্যবসায়ী এবং যে বা যারা ব্যক্তিগত ভবন তৈরি করবেন তাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা হবে অপরিণামদর্শী। ভিন্ন ভিন্ন তদারকি সংস্থার অনুমোদন শর্তের পারস্পরিক বৈপরীত্যের শিকার হবেন যারা ভবন নির্মাণ করবেন তারা। দু’টি প্রশাসনকে একটি কাজের দায়িত্ব দিলে জনগণের ভোগান্তি শুধুই বাড়বে। ফাইল ছোড়াছুড়ির নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে এবং নতুনভাবে প্ল্যান পাস করতে সময় বেশি লাগবে। ভবন তৈরিতে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন, অতিরিক্ত জটিলতা-ভোগান্তি-বিড়ম্বনা এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্যয় সবই বৃদ্ধি করবে। এমনিতেই অস্বাভাবিকভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে। ব্যয় বৃদ্ধির নতুন নতুন খাত নাগরিকদের আবাসনের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। মৌলিক অধিকারের স্বপ্ন অপূর্ণ এবং অধরাই থেকে যাবে। যা কাম্য নয়।
রিহ্যাব সহ-সভাপতি সোহেল রানা বলেন, এ সিদ্ধান্তে ভালো কাজ কিছুই হবে না; বরং যারা প্ল্যান জমা দেবেন তাদের হয়রানি বাড়বে। ভবনের প্ল্যান পাস করতে গেলে রাজউকেই মানুষকে হয়রানি পোহাতে হয়। সেখানে নতুন করে অনুমোদনের দায়িত্ব পেলে অবকাঠামো যারা বানাবেন তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হবে সিটি করপোরেশনগুলো। সিটি করপোরেশনের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায়, এমনিতেই সিটি করপোরেশনের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার শেষ নেই। জন্মসনদ জটিলতাসহ সারাবছর মশা, ডেঙ্গু লেগেই থাকে। যদিও বর্তমান মেয়রদ্বয় (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) ব্যক্তি উদ্যোগে নানা ভালো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন তথাপি সিটি করপোরেশনকে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত এই দায়িত্ব দিলে জনবল ও সক্ষমতাহীন এই সিটি করপোরেশনেও হয়রানির ক্ষেত্র তৈরি হবে ভয়াবহভাবে।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: