‘বিভাজন আমাদের দুর্বলতা নয়, রাজনৈতিক পরিণতির অংশ’

প্রথম নিউজ, অনলাইন: জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কাউন্সিলে সংগঠনটির মুখপাত্র নির্বাচিত হয়েছেন সিনথিয়া জাহীন আয়েশা। তিনি বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। এর আগে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক নম্বর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন, সংগঠন নিয়ে অভিযোগসহ নানান বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান।
আমরা যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলাম, তাদের প্রত্যাশা ছিল দ্রুত একটি ন্যায্য, সমতা ও গণতন্ত্রভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে অগ্রসর হবো। বাস্তবতা হচ্ছে এই পথটা পূর্বানুমেয় ছিল না
জাগো নিউজ: প্রথম কাউন্সিলে মুখপাত্র নির্বাচিত হলেন। সংগঠন নিয়ে কীভাবে কাজ করতে চান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা: প্রথম কাউন্সিল ছিল আমাদের জন্য আত্মসমীক্ষার ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমাকে মুখপাত্র হিসেবে নির্বাচিত করায় আমি সম্মানিত বোধ করছি। তবে এটাকে দায়িত্বের জায়গা থেকেই দেখছি। এই দায়িত্ব কেবল মুখ খোলার নয়, বরং সংগঠনের কণ্ঠস্বর, মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা বহন করার।
আমরা রাজনীতিকে দেখি দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম হিসেবে। স্বল্পমেয়াদি হতাশা নয়, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণের রাজনৈতিক ইচ্ছাই আমাদের চালিত করছে। তাই এই তফাতকে আমরা ব্যর্থতা নয়, বরং বাস্তবতা বোঝার শিক্ষা হিসেবে দেখছি
আমরা এমন এক সময় দাঁড়িয়ে আছি যখন রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির কাঠামো—সবই নতুন প্রশ্নের মুখে। আমাদের সংগঠন একটি নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা খুঁজছে, সবকিছু আমরা জিজ্ঞাসার আওতায় আনছি। আমার মূল কাজ হবে এই প্রশ্নগুলো ধারাবাহিকভাবে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসা, সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করা এবং ভেতর-বাইরের মধ্যে এক সেতুবন্ধ তৈরি করা। জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা। অভ্যুত্থানে আহত শহীদ পরিবারের পাশে ভ্যানগার্ড হয়ে থাকা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে—নৈতিক নেতৃত্ব তৈরির পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে সংগঠনের ভিত্তি গড়ে তোলা। আহত শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন আমাদের মূল লক্ষ্য।
জাগো নিউজ: কাউন্সিলে আপনাদের চার সদস্যদের কমিটি গঠিত হয়েছে। এটি বর্ধিত হবে কি না? শুধু কি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে নাকি জেলা উপজেলায় কমিটি দেবেন?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা: বর্তমানে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চার সদস্যের একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে। সংগঠন পরিচালনা করার জন্য শিগগির আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং বিভিন্ন সেল গঠনের বিষয়ে ভাবছি। এছাড়া মিটিংয়ের মাধ্যমে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আমরা স্পষ্টভাবে বলছি—এ সংগঠনের কাঠামো হবে বিকেন্দ্রীভূত, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল। তবে আমরা কাঠামো নির্মাণকে শুধু প্রশাসনিক প্রশ্ন হিসেবে দেখছি না, এটি আমাদের কাছে রাজনৈতিক ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। আমাদের সংগঠনের ভিত্তি হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমালোচনাকে স্বাগত জানানো এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার ভিতরে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব।
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা: গত এক বছর আমাদের জন্য ছিল আত্মসংঘর্ষ, পুনর্মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার এক কঠিন, কিন্তু জরুরি সময়।
আমরা যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলাম, তাদের প্রত্যাশা ছিল দ্রুত একটি ন্যায্য, সমতা ও গণতন্ত্রভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে অগ্রসর হবো। বাস্তবতা হচ্ছে এ পথটা পূর্বানুমেয় ছিল না। দমননীতি, বিভ্রান্তি, অবিশ্বাস ও ইতিহাসের ভার আমাদের পথ সহজ করে দেয়নি। কিন্তু প্রাপ্তি হচ্ছে আমরা আজও একসঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছি, বিকল্প নির্মাণের চেষ্টা করছি এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।
আমরা রাজনীতিকে দেখি দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম হিসেবে। স্বল্পমেয়াদি হতাশা নয়, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণের রাজনৈতিক ইচ্ছাই আমাদের চালিত করছে। তাই এই তফাতকে আমরা ব্যর্থতা নয়, বরং বাস্তবতা বোঝার শিক্ষা হিসেবে দেখছি।
জাগো নিউজ: সদ্য সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সংগঠন থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নানান ধরনের অভিযোগ করেছেন। প্ল্যাটফর্মে কি আগের মতো ঐক্য নেই?
সিনথিয়া জাহীন আয়েশা: উমামা ফাতেমা সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং তার অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তিনি সংগঠন থেকে নিজ সিদ্ধান্তে সরে গেছেন এবং কিছু অভিযোগও এনেছেন, যা আমরা গুরুত্ব সহকারে শুনেছি। পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি। তবে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে মতবিরোধ বা নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিমত থাকা অস্বাভাবিক নয়। বরং এর মধ্য দিয়েই সংগঠন নিজেকে পরিপক্ব করে।
আমরা মনে করি ঐক্য মানে এক রকম চিন্তা নয়, বরং ভিন্ন মতের সহাবস্থান, বিতর্ক ও সংলাপের মধ্য দিয়েই একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম টিকে থাকতে পারে। আমরা আগের মতো ঐক্য চাই না। আমরা চাই আরও গভীর, আরও সৎ এবং রাজনৈতিকভাবে পরিণত ঐক্য। বিভাজন আমাদের দুর্বলতা নয়, বরং রাজনৈতিক পরিণতির অংশ।