বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ১২৬ শতাংশ
প্রথম নিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন বিদেশিরা। বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার মধ্যেই চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে ইতিবাচক ধারা বইছে বিদেশি বিনিয়োগের। শেয়ারবাজারে গত মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
দেশে ৩৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য খাতে রফতানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। এর বড় একটি অংশ আসবে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে। এছাড়া অবকাঠামো খাতেও বিনিয়োগের জন্য বিদেশিদের আগ্রহী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার রূপকল্প-২০৪১ সালের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে বস্ত্র, রাসায়নিক ও কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।
গত মার্চ মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মোট টার্নওভার ছিল ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এপ্রিল মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮২ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে বিদেশিদের লেনদেন বেড়েছে ৯৫ কোটি টাকা বা ১০৮ শতাংশ। এই চিত্র শুধু শেয়ারবাজারে নয়, সব খাতেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি এই সাত মাসে এফডিআই এসেছে ৩০৬ কোটি ডলার। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ২৭৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় এই খাতকে ব্যবহারের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। কারণ, অনেক দেশই তাদের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। এখানে যদি সেই চাহিদাকে অ্যাড্রেস করা যায়, তাহলে এটিও রফতানির জন্য বিশাল খাত হয়ে উঠতে পারে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হচ্ছে, সেটা কিনা সিঙ্গাপুরের কয়েকগুণ বড়। আর এই বাজারে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগ্যপণ্য ব্যবহার বেড়েছে, বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। সে জন্য অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এরমধ্যেই বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে আসতে শুরু করেছে।
এদিকে ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) ২০২১ সালে একটি গবেষণা করেছিল, সেখানে কৃষি ব্যবসাতে বিনিয়োগের জন্য অবারিত সুযোগ আছে বলে চিহ্নিত করা হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কৃষি, ডিজিটাল ইকোনমি ও গ্রিন ফাইন্যান্স- এই তিনটা খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ বিজনেস সামিট উদ্বোধন করার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিক এবং পরিবহন খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতই ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে চলতি মাসে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানান। এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও ভারী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সার, আইসিটি, সামুদ্রিক সম্পদ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদিসহ অনেক গতিশীল ও সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গত এক দশকে স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল জাতীয় শিল্পের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে ওঠায় এসব সহযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। বাংলাদেশে গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ, নাট-বল্টু, বেয়ারিং ইত্যাদি অনেক কিছুই এখন তৈরি করা হয়। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করে বাংলাদেশে গাড়ির যন্ত্রাংশ, ধান মাড়াই মেশিন, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, নানারকম খেলনা তৈরি করা হয়। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে ৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হালকা প্রকৌশল খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে দেশের চেহারা বদলে যাবে।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এই দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। বিডায় নিবন্ধিত শিল্পের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ, এ তিন মাসে বিডায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট ২৩১টি শিল্প ইউনিট নিবন্ধিত হয়েছে। এরমধ্যে ২০৬টি শিল্প ইউনিট স্থানীয়, ১১টি শতভাগ বিদেশি ও ১৪টিতে যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এরমধ্যে দেশীয় বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রায় ১১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার। আর ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে।
গত বছরের (২০২২) জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২২৭ কোটি টাকার। সে হিসাবে বিডায় বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২৬ শতাংশ। নিবন্ধিত এসব বিনিয়োগ প্রস্তাবকে কখনও চূড়ান্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কারণ, যারা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়ে নিবন্ধন নেন, পরে তাদের একটা অংশ বিভিন্ন বাস্তবতায় আর বিনিয়োগ করেন না।
অবশ্য গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে একটি আয়োজনে অংশ নিতে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে যাবেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল। ৬ থেকে ১৭ মে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। এতে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
এর আগে গত মার্চ মাসে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিডা কার্যালয়ে লাতিন আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এলএবিসিসিআই) ও বিডা একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, বিডা ও এলএবিসিসিআইয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। তার মতে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
৬ থেকে ১৭ মে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে একটি ব্যবসায় আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে। যৌথভাবে এই আয়োজন করেছে বিডা, এলএবিসিসিআই ও ডাচ্-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিবিসিসিআই)।