প্রবাসে নির্যাতন মুক্তিপণ আদায় মাদারীপুরে

প্রবাসে নির্যাতন মুক্তিপণ আদায় মাদারীপুরে
প্রবাসে নির্যাতন মুক্তিপণ আদায় মাদারীপুরে

প্রথম নিউজ, মাদারীপুর : বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ইতালিতে নেয়ার কথা বলে প্রথমে নেয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। কখনো কখনো সেই নির্যাতনের ভিডিও করে পাঠানো হয় স্বজনদের কাছে। কখনো ভিডিও কলে দেখানো হয় সেই নির্মম নির্যাতন। নির্যাতন করা হয় শুধু মুক্তিপণের টাকা আদায়ের জন্য। এমন একটি চক্রের  সন্ধান পাওয়া গেছে মাদারীপুরে। মানব পাচারের শিকার একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে লোমহর্ষক এই তথ্য। চক্রটি প্রথমে অল্প খরচে লিবিয়া হয়ে ইটালি যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। লিবিয়া নেয়ার পর তাদের লিবিয়ার দুর্গম কোনো স্থানে আটকে রাখা হয়। চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতনের মূলহোতা মাফিয়া শরীফ। মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের নতুন মাঠ গ্রামের সাকা মাতুব্বরের মেয়ে সুমিকে বিয়ে করেন শরীফ।

সুমিসহ একাধিক দালাল মাদারীপুর থেকে লোক সংগ্রহ করে লিবিয়াতে পাঠায়। লিবিয়াতে যারা নির্যাতন করে তাদেরই একজন আজিজুল ইসলাম নির্ঝর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্যাতন চালানো আজিজুল হক নির্ঝর (২৭) মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। তিনি লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী। তার দায়িত্ব ছিল বন্দিশালার বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা। 

মাদারীপুর সদর উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের রাকিব ফরাজী নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘শরীফের ক্যাম্পে আমি বন্দি ছিলাম। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২টি ছেলে মারা গেছে। আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারো মেরেছে। ফলে আমার চোখের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল।’ নির্যাতনের শিকার আরেক ভুক্তভোগী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বনি আমিন। তাকে ক্যাম্পে আটকে রেখে মুুক্তিপণের জন্য কয়েক দফায় নির্যাতন চালানো হয়। পরে শরীফের স্ত্রী সুমি এজেন্ট ব্যাংকিং নম্বরে ২০ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। শুধু বনি আমিন আর রাকিব ফরাজী নয়। এমন হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে চক্রটি।

মুন্সীগঞ্জ জেলার মোল্লাকান্দি গ্রামের সেলিম শেখের ছেলে জাহাঙ্গীর শেখ (২৭)কেও নির্যাতন করা হয়। লিবিয়ার মাফিয়া শরীফের বন্দিশালায় থাকাকালীন আজিজুল হক নির্ঝরের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ২০২১ সালের ১৬ই নভেম্বর কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানে মাফিয়ার খপ্পরে পড়ে বন্দিশালায় এমন বিভীষিকাময় জীবন কেটেছে তার। পরে টাকার বিনিময়ে লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে হাইতেম নামের এক দালালের মাধ্যমে ২০২২ সালের ৬ই এপ্রিল পৌঁছেছেন ইতালিতে। দীর্ঘদিন ইতালির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর শেখ বলেন, ‘নির্ঝর এতটাই নির্দয় ছিল যে, ও কাউকেই ছাড়তো না। বাপ-চাচার বয়সী লোকজনকেও টাকার জন্য প্রচুর মারধর করতো।

 গলায় পাড়া দিয়ে, দাড়ি টেনে কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন চালাতো। বন্দিশালার জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে করা নির্যাতন দেখে বাবা স্ট্রোক করে মারা গেছে। পরিবারের লোকজন আমার কাছে বাবার মৃত্যুর খবর গোপন রেখেছিল। আমরা হয়তো ভুল করে এ পথে এসেছি। প্রশাসনের কাছে আমরা এর বিচার চাই।’ সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে ফিরেছে অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর। মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও কাজের সন্ধানে লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা বন্দি করে শরীফের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের বন্দিরা সবাই অনেক কান্নাকাটি আর চেচামেচি করতো। আমি ভাষা জানতাম বলে শরীফ আমাকে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়েছিল সবাইকে চুপচাপ রাখার। সে সময় অনেককেই গালাগালি করেছি তাই হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে অভিযোগ দিতে পারে। আমি কারও কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করিনি। টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। আমি শুনেছি ওখানে সাড়ে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ করে টাকা নেয়া হয়। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেইনি। আমি শুধু সবাইকে চুপচাপ রাখার জন্য শাসন করেছি। আমি ক্যাম্পে ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য এই দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ যদি আমার নামে অভিযোগ করে থাকে সেটা সত্য না।’ এ ব্যাপারে জানতে লিবিয়াতে অবস্থানরত মাফিয়া শরীফের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করেননি। এসএমএস করলেও জবাব দেননি। তার স্ত্রী সুমি আক্তার ও তার পরিবার কয়েক মাস যাবৎ এলাকা ছাড়া।

এ বিষয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। মানবপাচার রোধে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষকে কোথাও আটকে রেখে জিম্মি করে টাকা-পয়সা নেয়া মেনে নেয়া যায় না। তাই আমরা আইনের মধ্যে থেকেই মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করছি, অনেককে আমরা গ্রেপ্তারও করেছি। আর সকল অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলা, তারা যেনো অবৈধ পথে তাদের সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom