নতুন উত্তাপ নিত্যপণ্যের বাজারে

নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সর্বস্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

নতুন উত্তাপ নিত্যপণ্যের বাজারে

প্রথম নিউজ, অনলাইন: গত বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ছিল না। বিভিন্ন ধরনের অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতো সিন্ডিকেট চক্র। চাল, তেল, চিনি, আলু, পিয়াজ, মাছ, মুরগি, ডিম ও মাংসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়। ভোক্তাদের প্রত্যাশা ছিল, নতুন বছর, পাশাপাশি নির্বাচনের পর নিত্যপণ্যের বাজারে হয়তো স্বস্তির দেখা মিলবে। কিন্তু ভোগ্যপণ্যের বাজারে নতুন বছরও অস্বস্তি দিয়ে শুরু ক্রেতাদের। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সর্বস্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলান করার কোনো পথ তারা খুঁজে না পেয়ে মধ্যবিত্তরা দিশাহারা।

এদিকে রমজান মাস শুরু হবে মার্চের মাঝামাঝি। বাজারে সরবরাহ বাড়তে আসন্ন রমজান মাসে ৮ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওদিকে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বড় চিন্তা নীতি-নির্ধারকদের। কারণ মূল্যস্ফীতি কিছুতেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। বাজারেও ভোগ্যপণ্যের দাম খুব একটা কমেনি।গত মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। আর চার মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি।

রাজধানীর বাজারে দেখা গেছে, বাজারে শীতের শুরুতে ৩০ টাকা বিক্রি হওয়া প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। ৫০-৬০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। এভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। বর্তমানে সবজির ভরা মৌসুম হলেও দাম চড়া। বাজারে নতুন আলুতে ভরপুর, তবুও এক কেজি আলু কিনতে ব্যয় হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। গত বছর এসময় আলুর কেজি ছিল ১৬ থেকে ২২ টাকা। এবার ভরা মৌসুমেও কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। তবে পুরোনো আলুর দর আরও বেশি।

একইসঙ্গে বাজারে দেশি নতুন পিয়াজের সরবরাহ ব্যাপক। অথচ এক কেজি পিয়াজ কিনতে খরচ হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা। মুড়িকাটা জাতের পিয়াজ বাজারে আসায় দাম কিছুটা কমলেও চড়া পুরোনো পিয়াজের দাম। নতুন পিয়াজের কেজি ৯০-১০০ টাকা, পুরোনো পিয়াজ ১৩০-১৫০ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম আবারো ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে প্রতিটি পণ্যের দামই ক্রেতার নাগালের বাইরেই রয়েছে। ফলে হতাশ ক্রেতারা।

বাজারে আটা, ময়দা, পিয়াজ, রসুন ও আদার দাম বেড়েছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
টিসিবি বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্যাকেটজাত আটা ও ময়দার দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। এখন বাজারে প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এ দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এ হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে প্যাকেটজাত আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৪.৩৫ শতাংশ।

একই সময়ে বাজারে পিয়াজের দাম সাড়ে ৫ শতাংশ বেড়ে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। একইসঙ্গে সপ্তাহের ব্যবধানে রসুনের দাম ৪.৩৫ শতাংশ এবং আদার দাম ২.২২ শতাংশ বেড়েছে। বাজারে এখন প্রতি কেজি আদা এবং রসুন একই দামে ২০০ থেকে ২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ময়দার দামও বেড়েছে। বাজারে এখন প্যাকেটজাত প্রতি কেজি ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। গত সপ্তাহেও এ দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। সে হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে প্যাকেটজাত ময়দার দাম বেড়েছে ৩.৫৭ শতাংশ। এসময় খোলা ময়দার সর্বনিম্ন দাম ৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। তবে মানভেদে খোলা ময়দা কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। এতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে ৩.৮৫ শতাংশ। 

সবজির বাজারে শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, মুলা ৪০-৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হলেও এখন কেজিতে ১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০-৮০ টাকায়। প্রতিটি লাউ কিনতেও খরচ করতে হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা।
এ ছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে দেশি রসুন ২৮০ টাকায় এবং আমদানি করা রসুন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশি রসুন ২৬০ টাকা ও আমদানি করা রসুন বিক্রি হয়েছিল ২২০ টাকায়। আড়ত পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২১০ টাকায়। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯০ টাকায়। কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়ে মানভেদে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়। 

ডজনে ৫ টাকা বেড়ে ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। তবে দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ২০০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে।  মাছের বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি রুই ৩৮০-৪৫০ টাকা, কাতলা ৪০০-৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, টেংরা ৬৫০ টাকা, চাষের পাঙাশ ২০০-২২০ টাকা ও তেলাপিয়া ২০০-২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ছোলা খুচরায় কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা এবং ছোলার ডাল, খেসারির ডাল, মুগ ডাল ও বেসনের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। ছোলার ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। খুচরায় খেসারির ডাল প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা কেজি। দেশে বর্তমানে রেকর্ড দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৪৫ ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাল চিনি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।

বাস্তবতা হলো, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। কারণ বাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক চড়া। কোনো পণ্যের দাম কমছে না। এমনকি দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো সুখবরও নেই। যদিও বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমেছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পণ্য আমদানিতে যেন পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করা হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হবে। এখন পণ্যের সরবরাহ কিছুটা কমলেও সার্বিকভাবে আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক। একইসঙ্গে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো যেন কম বা শূন্য মার্জিনে এলসি খোলে সে বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে। ভোজ্য তেল ও চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল। ডাল, ছোলার দামও স্থিতিশীল। দেশি পিয়াজের উৎপাদন ভালো, দাম কম হবে। তাই সার্বিকভাবে বলা হয় রমজানে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে।

এদিকে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সুখবর দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা, বরং তারা আমদানি পণ্য সরবরাহ নিয়ে নানান ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। ডলার সংকটে এলসি খোলার সমস্যা ছাড়াও ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা, যা প্রত্যক্ষভাবে বড় প্রভাব ফেলছে পণ্যের দামে। আয়-ব্যয়ের সঙ্গে কুলাতে না পেরে নিত্যপণ্য কেনাকাটায় কাটছাঁট করছেন অনেকেই। কাওরান বাজারে আসা মামুন বলেন, কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্য কেনাও কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। ভালো খাবার কাটছাঁট করে সংসার খরচ সামাল দিতে হচ্ছে। 

মগবাজারের বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, অন্য বছরে হয়তো একটি-দুটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গত বছরে খাদ্যপণ্য, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, প্রসাধনী পণ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ- এককথায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। তাই আশা ছিল নির্বাচনের পর হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলবে বাজারে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু দেখলাম না। 

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সীমিত আয়ের মানুষের খাবারগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে যুক্ত। যখন পাঙাশ, তেলাপিয়া মাছের দাম, ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম বাড়ছে, তখন হয়তো ডিমের চাহিদা বেশি হয়। ডিমের দাম বেশি হলে ভর্তা-ডালের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। যখন সবকিছুরই দাম বাড়বে তখন আর তাদের কোনো বিকল্প থাকে না, কষ্টের মধ্যেই চলতে হয়।