দখলে ম্লান ছয় লেনের সুফল

 দখলে ম্লান ছয় লেনের সুফল

প্রথম নিউজ, ঢাকা : প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে। নগরীতে চলাচল করে সাড়ে তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন। পাশাপাশি আছে তিন লাখের বেশি প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। নগরীজুড়ে যত্রতত্র পার্কিং, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, অবৈধ যানবাহন চলাচল করার কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনা, প্রতারণা কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে মাশুল গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকেই। নগর ট্রাফিকের অব্যবস্থাপনা নিয়ে নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব।

চট্টগ্রাম মহানগরীর তিন ব্যস্ত সড়ক শাহ আমানত সেতু-বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও পোর্ট কানেকটিং রোড। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সড়ক তিনটির প্রভাবও বিস্তর। যে কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় লেনের সড়কে রূপ দেয় সরকার। কিন্তু এ তিন সড়কেই উভয় দিকের বাম পাশের দুটি লেন গাড়ির গ্যারেজ, পার্কিং, দোকানের মালামাল রেখে দখল করে রাখা হচ্ছে। এতে সড়কে হচ্ছে যানজট। আবার পাহারার নামে মূল সড়ককে বানানো হয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড। যেখান থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগও রয়েছে।

জানা যায়, ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পর্যটননগরী কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আট উপজেলার সঙ্গে মেলবন্ধ তৈরি হয়। তবে ওই সময় থেকে সেতু ব্যবহার শুরু হলেও ওই প্রকল্পের আওতায় সংযোগ সড়কটি নির্মিত না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সড়ক ব্যবহারকারী লাখো মানুষ। পরবর্তীসময়ে কেএফএইডি (কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট) ও সরকারি ২৭০ কোটি টাকা অর্থায়নে সেতুর উভয় পাশে আট কিলোমিটার সংযোগ সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। প্রকল্পের আওতায় শিকলবাহা ক্রসিং থেকে মইজ্যারটেক পর্যন্ত তিন কিলোমিটার চার লেন এবং নগর অংশে নতুন ব্রিজ গোলচত্বর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প কাজ শেষে ২০২০ সালের শুরুতে সড়কটি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদার। পরবর্তীসময়ে দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নগরীর পাঁচ কিলোমিটার সড়কের বেশিরভাগ অংশে বাম পাশের লাইনটিকে ব্যবহার উপযোগী করা যায়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর শাহ আমানত সেতুর গোলচত্বর থেকে রাজাখালী পর্যন্ত উভয় দিকের একটি লেনের বিভিন্ন স্থানে ট্রাক, বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। কোথাও গ্যারেজ বানিয়ে সড়কে গাড়ি মেরামত করা হচ্ছে। রাজাখালী মোড়ে চাক্তাই প্রবেশের জন্য মূল সড়কের বাম পাশ দখল করে রাখে পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান। তুলাতলী এলাকার ব্রিজটির দক্ষিণ পাশের অংশে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের মালামাল রেখে ব্রিজের একটি লেন অকেজো করে রাখা হয়েছে। তুলাতলী মোড়ে এক লেন দখল করে বসানো হয়েছে হকার ও অস্থায়ী দোকান। ওই স্থানে সড়কের মধ্য লেনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেয় বাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো।

তুলাতলী এলাকায় বাসচালক আলাউদ্দিন বলেন, ‘এখানে বাম লেনে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। কোথাও দোকান বসানো হয়েছে, কোথাও গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়েছে। এ কারণে বাধ্য হয়ে সড়কের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী নিতে হচ্ছে। অথচ এসব দখল মাসের পর মাস থাকে। ট্রাফিক কিংবা থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অনেক সময় যানজট তৈরি হয়।’

একইভাবে কল্পলোক আবাসিক লাগোয়া উভয় দিকে দখলে রাখা হয়েছে বামপাশের লেন। সড়কের কালামিয়া বাজার ও রাহাত্তারপুর ওভার পাস বাদে পুরো সড়কের উভয় দিকের বাম লেন একেবারে ব্যবহার অনুপযোগী। ওভারপাস দুটির নিচেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা পার্কিং করে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে মুরাদপুর-লালখান বাজার ফ্লাইওভারের পর শাহ আমানত সেতু বহদ্দারহাট সংযোগ সড়কটি দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। নতুন ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গিবাজার কোতোয়ালি হয়ে আগ্রাবাদ যেতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে বহদ্দারহাট সংযোগ সড়ক হয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে আরও কম সময়ে আগ্রাবাদ যাওয়া যায়। নতুন ব্রিজ থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে কোনো বিরতি দিতে হয় না। এ সড়কটির মাধ্যমে উন্নয়নে নতুন মাইলফলক তৈরি হয়েছে। তবে সড়কটি ব্যবহার শুরু হতে না হতে দুই দিকের দুই লেনে বিভিন্ন স্থানে গ্যারেজ, পার্কিং বানিয়ে রাখা হয়েছে। এতে পথচারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে নগর ট্রাফিক বিভাগ। এ বিষয়ে কথা হলে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) এম এ মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ট্রাফিকে নতুন জয়েন করেছি। যে সড়ক তিনটি দখলের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আমার অফিসারদের মাধ্যমে পরিদর্শন করে কোথায় কী কারণে দখল হয়েছে বা সড়ক ব্যবহার করা যাচ্ছে না, সেটা দেখে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেবো। কোথাও অবৈধ দখল হয়ে থাকলে তা উচ্ছেদ করে সড়ক জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’

ট্রাফিকের পকেটে চাঁদার ভাগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করে দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো ঘটনায় পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তারা যে স্তরেরই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহ আমানত সেতু থেকে বহদ্দারহাট সংযোগ সড়ক পাঁচ কিলোমিটারের। এখানে ছয় লেন সড়ক রয়েছে। মূলত সড়কে পুলিশই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করে। নগর অংশে পাঁচ কিলোমিটার সড়কের কোনো লেন বন্ধ থাকলে কিংবা অবৈধ দখল হলে আমরা অবশ্যই এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’

সড়কটিতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তদারক করে সিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ। এ বিভাগের টিআই (বাকলিয়া) অপূর্ব কুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন ব্রিজ-বহদ্দারহাট সংযোগ সড়কের নতুন ব্রিজ থেকে শুরু করে সড়কের দুপাশে একশর বেশি গ্যারেজ রয়েছে। রাজাখালী এলাকায় খাতুনগঞ্জের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো প্রবেশ করে। আবার বহদ্দারহাট থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলো নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে যাত্রী নেয়। যে কারণে সড়কের একপাশ প্রায়ই বন্ধ থাকে। এতে আমরা প্রতিদিনই সড়কটি পরিদর্শন করি। পার্কিং করা গাড়ি তাড়িয়ে দেই। অনেক বাস-ট্রাকের বিরুদ্ধে মামলা দেই। পরে আবারও একই অবস্থা হয়।’

প্রায় ২২০ কোটি টাকা অর্থায়নে পোর্ট কানেকটিং রোড ও আগ্রাবাদ অ্যাক্সেস রোড সম্প্রসারণ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। ২০২২ ও ২০২১ সালে ছয় লেনের সড়ক দুটি পুরোপুরি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সড়ক দুটি সম্প্রসারণের কারণে নগরীর যোগাযোগ কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। তবে সড়ক দুটিতে যত্রতত্র পার্কিং, গ্যারেজ, স্ট্যান্ড কিংবা ফুটপাত দখলের কারণে সুফল ম্লান হচ্ছে। সড়ক দুটির তদারক ও রক্ষণাবেক্ষণও করে সিটি করপোরেশন।

বিশেষ করে আগ্রাবাদ লাকী প্লাজার মোড় থেকে অ্যাক্সেস রোডে পুরো সড়কটির উভয় দিকের বাম লেনে অসংখ্যা মোটরগাড়ির গ্যারেজে গাড়ি মেরামত চলে। মাসের পর মাস লেন দুটি গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী থাকে। হালিশহর এলাকার বাসিন্দা রবিউল আলম বলেন, ‘আগ্রাবাদ অ্যাক্সেস রোডের বড়পোল থেকে শুরু করে ছোটপোল পুলিশ লাইন, শান্তিবাগ, বেপারী পাড়া, হাজি পাড়া হয়ে বাদামতলি মোড় পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়েছে। নষ্ট গাড়ি মাসের পর মাস সড়কের বাম লেনে ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে এসব গাড়ির আড়ালে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। এতে পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। আবার সড়কের দুপাশে দোকানদাররা ফুটপাত দখল করে পথচারীদের রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করছেন।’

এখানকার দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই-হালিশহর) সালাহউদ্দিন মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সড়কে দখল ও অবৈধ পার্কিং করা হলেও নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। গাড়িগুলোকে মামলা দেওয়া হয়।’

অলংকার থেকে শুরু করে নিমতলা পর্যন্ত পোর্ট কানেকটিং সড়কের প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের বেশি সড়কের দুই লেন দখলে থাকে মাসের পর মাস। অনেক সময় ছয় লেনের চার লেনেই ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি, দূরপাল্লার বাস পার্কিং করা হয়। নিমতলা ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় স্ট্যান্ড পেরিয়ে পোর্ট কানেকটিং রোডে ট্রাক কাভার্ডভ্যানের স্ট্যান্ড বসিয়েছেন স্থানীয় মাস্তান ও শ্রমিক নেতারা। তারা ওই এলাকায় দাঁড়ানো ট্রাক থেকে দিনপ্রতি চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ। ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের চালকরা বলছেন, এখানে যারা চাঁদা তোলেন, তাদের নির্ধারিত চাঁদা দিলে পুলিশ আর কোনো ডিসটার্ব করে না। গাড়ির কোনো মালামালও চুরি হয় না। কিন্তু টাকা না দিলে বিপরীত হয়।’

বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর নিমতলা ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন পোর্ট কানেকটিং সড়কে কথা হয় কাভার্ডভ্যান চালক মোশাররফ হোসেন সুমনের সঙ্গে। তিনি তার ট্রাকটি রাস্তার একপাশে আড়াআড়ি করে পার্কিং করেছেন। কথা হলে তিনি বলেন, ‘এখানে পাহারাদারদের দিনপ্রতি দিতে হয় দেড়শ টাকা। একঘণ্টা রাখলেও দেড়শ টাকা দিতে হয়। স্ট্যান্ডে রাখলে দিতে হয় দুইশ টাকা। সড়কের এ পাশে স্থানীয় লোকজন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামেও টাকা তোলে। তাদের টাকা দিলে গাড়ির কিছু চুরি হয় না। পুলিশও কোনো ঝামেলা করে না।’

সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে স্থানীয় চাঁদাবাজরা তাকে ওই স্থান থেকে গাড়ি সরিয়ে নিতে বাধ্য করেন। পরে বাধ্য হয়ে চালক সুমন তার কাভার্ডভ্যানটি সরিয়ে নিয়ে যান। তখন পাশেই ওই এলাকার ট্রাফিক সার্জেন্ট দায়িত্ব পালন করছিলেন। এক কনস্টেবলকে নিয়ে সড়কের অন্য গাড়ি আটকিয়ে চেক করছিলেন তিনি।
আমদানিকারক ব্যবসায়ী মাহবুব রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমদানি পণ্য নেওয়া হয় আবার রপ্তানি পণ্য বন্দরে আসে। আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক কাভার্ডভ্যানের সিংহভাগই বন্দরে প্রবেশ করে পোর্ট কানেকটিং রোড হয়ে। অথচ নিমতল, সরাইপাড়া এলাকায় রোডের দুপাশে গাড়ি স্ট্যান্ড বানিয়ে রাখা হয়।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর ফুটপাত দখলমুক্ত করার অভিযান আমরা শুরু করেছি। নগরীর নিউমার্কেট এলাকার পর আগ্রাবাদ এলাকায় আমাদের অভিযান শুরু হবে। আগ্রাবাদ অ্যাক্সেস রোড এবং পোর্ট কানেকটিং রোডের ফুটপাত ও চলাচলের সড়ককে দখলমুক্ত করা হবে।