টাকা জমা রেখে সরকারি কর্মচারীরাই সর্বোচ্চ ১৩% সুদ পান
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে ৩ আগস্ট রোববার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: সরকারি কর্মচারীদের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) ও প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে (সিপিএফ) টাকা জমা রাখার বিপরীতে সুদের হার আবার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে ৩ আগস্ট রোববার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রাখলে সুদ মিলবে ১৩ শতাংশ। ১৫ লাখ ১ টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত রাখলে সুদ পাওয়া যাবে ১২ শতাংশ এবং ৩০ লাখ ১ টাকার বেশি টাকা জমা রাখার বিপরীতে ১১ শতাংশ সুদ মিলবে।
জিপিএফ-সিপিএফে টাকা রাখলে সরকারি কর্মচারীরা একসময় ১৩–১৪ শতাংশ সুদ পেতেন। এই হারকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালিন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে কমিয়ে ১১ থেকে ১৩ শতাংশ করা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে একই সুদহার বহাল রাখা হয়। এবারও তাই করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদও এত বেশি নয়—সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ।
একসময় সরকারি কর্মচারীরা মূল বেতনের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত জিপিএফে টাকা রাখতে পারতেন। তবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ বিভাগ সুদের হার না কমিয়ে জিপিএফে টাকা রাখার সীমা কমিয়ে মূল বেতনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। যেসব কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তাঁরা টাকা রাখেন জিপিএফে। আর যাঁরা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তাঁরা টাকা রাখেন সিপিএফে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের মতো সিপিএফভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংগতি এক রকম না হওয়ায় তারা নিজস্ব আর্থিক বিধিবিধান ও আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী জিপিএফের হার অনুসরণ করে সুদ দিতে পারবে। সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ সুদটা সরকারি কর্মচারীদের জন্য একধরনের সুবিধা এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় জিপিএফ-সিপিএফের বর্তমান সুদের হার ঠিকই আছে। আর এখন তো সব দিকেই সুদের হার বৃদ্ধির আলোচনা জোরালো হচ্ছে।
মাহবুব আহমেদ আরও বলেন, যে হার আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকে, অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী তা মুনাফা হতে পারে না। ধর্মীয় কারণে হয়তো শব্দটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সুদ না মুনাফা
অর্থ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এবার সুদের পরিবর্তে মুনাফা বলা হয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে সুদই লেখা। আবার সুবিধাভোগীরা একে সুদ বলতে নারাজ। তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মুনাফা বলতে। তবে সরকারের হিসাবের খাতায় যা সুদ, বিনিয়োগকারীদের কাছে সেটাই মুনাফা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুদ-মুনাফার এ বিভ্রান্তির জন্য সরকারই দায়ী। বাংলায় সব জায়গায় মুনাফা বলা থাকলেও ইংরেজিতে বলা আছে ইন্টারেস্ট রেট (সুদের হার)। বাংলায় মুনাফা বললে ইংরেজিতে প্রফিট বা লভ্যাংশ লিখে রাখার কথা থাকলেও অর্থ বিভাগ তা করছে না। যদিও সুদ আর মুনাফা যা–ই বলা হোক না কেন, বিনিয়োগকারীদের তা দেওয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকেই।
অর্থ বিভাগের প্রবিধি অনুবিভাগের ২০২০ সালের ১৭ জুনের এক চিঠিতে বলা হয়, সরকারি কর্মচারীদের পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০-এর ২.০৫ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ২.০৬ (ঘ) নম্বর অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ইএলপিসিতে কর্মচারীর ভবিষ্য তহবিলের মুনাফাসহ জমা অন্তর্ভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবসরগামী কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিলের স্থিতি দেওয়ার বিষয়ে আদেশ জারি করতে বলা হয়েছে।
অথচ আগে জারি করা পেনশন সহজীকরণ আদেশ ২০০৯-এ ভবিষ্য তহবিলের ‘মুনাফা’র বদলে ‘সুদ’ উল্লেখ ছিল, এ কথাও চিঠিতে বলা হয়েছে। বলা হয়, বর্তমানে ভবিষ্য তহবিলের সুদকে মুনাফা হিসেবে প্রতিস্থাপন করার কারণে বিদ্যমান ভবিষ্য তহবিলের হিসাব দেওয়া সংক্রান্ত ফরমে সুদের পরিবর্তে মুনাফা শব্দটি লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, অর্থ বিভাগ ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড রুলস, ১৯৭৯-এ ‘সুদ’ শব্দের পরিবর্তে ‘সুদ অথবা ইনক্রিমেন্ট’ শব্দ প্রতিস্থাপন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্য তহবিলের হিসাব দেওয়া সম্পর্কিত বিদ্যমান ফরমে ও তহবিলসংক্রান্ত সব ক্ষেত্রে ‘সুদ বা ইনক্রিমেন্ট’-এর পরিবর্তে ‘মুনাফা’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, হারটা বাজারের অন্য সব বিনিয়োগ পণ্যের তুলনায় বেশি। এ হার বাজারের কাছাকাছি থাকতে পারে, কিন্তু এত বেশি নয়। আর কেউ এটাকে মুনাফা বললে বলতেই পারেন, কিন্তু এটা সুদ ছাড়া কিছুই নয়। সরকার জিপিএফ-সিপিএফের টাকা নিয়ে খরচ মেটাচ্ছে, বিনিময়ে বেশি হারে ফেরত দিচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের। এমন নয় যে সরকার কোনো ব্যবসায়ে খাটিয়ে মুনাফা করে তার একটা অংশ ফেরত দিচ্ছে তাদের। ফলে প্রজ্ঞাপনে মুনাফা শব্দটির ব্যবহার অসংগত।