জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের শোকবার্তা
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের শোকবার্তা: তিনি সত্য,ন্যায় ও অধিকার আদায়ে ছিলেন সচেতন।
প্রথম নিউজ ঢাকা:গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ- বিএসপিপি।পরিষদের আহবায়ক প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও সদস্য সচিব সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী আজ এক শোকবাণীতে মুক্তিযুদ্ধ ,দেশে গ্ণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাস্থ্যখাতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন তিনি । মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মেডিকেল টিমের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে চিকিৎসা সেবা অসহায় মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদানের কথা স্মরণ করেন।
শোকবার্তায় পেশাজীবী নেতৃদ্বয় বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাদাকে সাদা আর কালকে কাল বলতেন। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সত্যের পথে অবিচল ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে জাতি 'সাচ্চা দেশ প্রেমিক' এক অভিভাবক হারালো।
এ জাতীয় বীরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলা হয়, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। জাতির যেসব সূর্যসন্তান আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে গেছেন তাদের অন্যতম তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরুপ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) ১৯৭৭ সালে তাঁকে প্রথম স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন।
স্বাধীন দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। লোভ-লালসা তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারে নি। বরং ভিন্নধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের সেবায়।প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। বিশেষ করে করোনাকালে দেশের মানুষ যখন ভয়াবহ খাদ্য ও অর্থ সংকটে পড়েছিলেন ঘোরতর সে দুর্দিনে সাহায্য নিয়ে তিনি দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান।
শোকবার্তায় বলা হয়, সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন বুকচিতিয়ে। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব তার সর্বোচ্চটাই করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি গুম, খুন, ক্রসফায়ারসহ বিনাবিচারে মানুষ হত্যা এবং গনতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা,ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বন্ধ মিডিয়া খুলে দেয়া, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রেরণ, কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে বেশ সোচ্চার ছিলেন। গর্জে উঠেছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে।যেখানে অন্যায় অবিচার সেখানে গর্জে উঠতো জাফর উল্লাহ চৌধুরীর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। সবমিলিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ব্যক্তিত্বের শিখরস্পর্শী এক উচ্চতায়। মহান এ ব্যক্তিত্বকে থামিয়ে দেয়ার জন্য বর্তমান সরকারের সময় অপমান, মানহানি আর অব্যাহতভাবে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ভুয়া মামলা।হেয় করার জন্য এই জাতীয় বীরের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলা হয়েছিল ভূমি দখলের। বিশেষ করে২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর চাঁদাবাজি, জমিদখল, পুকুরের মাছ চুরির অভিযোগসহ একের পর এক হাস্যকর মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের এন্টিবায়োটিকের কাঁচামাল জব্দ ও এন্টিবায়োটিক বিভাগ সিলগালা ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ১৫ লাখ টাকা। এসময় একজন জাতীয় বীরের বিরুদ্ধে সরকারের এমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়।গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার অভিযোগ এনে হাসপাতালকে আরো ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে। অথচ সাধারণ মানুষকে কমদামে ওষুধ সরবরাহ করতে তিনি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দামি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বদলে ট্যাবলেট তিনি প্যাকেট করার প্রচলন করেন সাধারণ কাগজে।
২০১৫ সালে বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের আদালত অবমাননার সাজায় উদ্বেগ জানিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি দেয়ার ঘটনায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টার কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
কিন্তু তিনি এসব পরোয়া করেন নি। নিপীড়ন চালিয়েও এক মুহুর্তের জন্যও থামানো যায়নি এ জাতীয় বীরকে।
১৯৮০ সালে জিয়ার গড়া প্রথম জাতীয় মহিলা উন্নয়ন কমিটির দুই পুরুষ সদস্যের একজন হিসেবে প্রাথমিকে ৫০ শতাংশ মহিলা শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ ছাত্রী নেয়ার সুযোগ করেছিলেন, যা কার্যকর হয়েছিল পরবর্তী সরকারের সময়।
জিয়াউর রহমানের আমলে পুলিশে মহিলা নিয়োগ দেয়া শুরু হলে দেশের প্রথম দুই নারী পুলিশ- হিসেবে নিয়োগ পান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী হোসনে আরা ও চামেলী বেগম।
জাতীয় সংকটে নিজের দায়বোধ থেকে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলায়। তিনি সুবিধাবাদী সুশীল নয়, একজন বিবেকবান বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তিনি কোনো ‘বাঁকা চোখের’ পরোয়া করেননি। শোকবার্তায় পেশাজীবীদের এই দুই শীর্ষ নেতা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।