কাতারের আমীর ঢাকায়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আজ

তাছাড়া বঙ্গভবনে আমীরের সম্মানে রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন হবে।

কাতারের আমীর ঢাকায়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আজ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: তাৎপর্যপূর্ণ সফরে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এখন ঢাকায়। সোমবার বিকালে বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে আমীর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমীরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। এ সময় রাজসিক আয়োজনে তাকে বরণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর যৌথ আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে আসা আমীরের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে আজ। তাছাড়া বঙ্গভবনে আমীরের সম্মানে রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন হবে। সেখানে আমীর, তার সফরসঙ্গী এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশি-বিদেশি অতিথিরা অংশ নেবেন। তবে বঙ্গভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরের প্রস্তাবিত অন্য কর্মসূচিতে আমীর অংশ নিচ্ছেন না বলে জানা গেছে। তবে এর কারণ চলমান হিট ওয়েব, নিরাপত্তা না সময় স্বল্পতা? তা পরিষ্কার হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অবশ্য বলেছেন, ‘সময়ের অভাবে’ কাতারের আমীর মিরপুরে দুটি স্থাপনার উদ্বোধনীতে যাচ্ছেন না।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে বা ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে কাতারের আমীরের না যাওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কার করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেন, তিনি খুব কম সময়ের জন্য ঢাকায় এসেছেন। খুবই টাইট শিডিউল। সে কারণে অনেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সেগুলো হচ্ছে না। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও আলাদা সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না বলে জানান ড. হাছান মাহমুদ। মিরপুরের কালশীতে বালুর মাঠে নির্মিতব্য পার্ক ও মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে কালশী ফ্লাইওভার পর্যন্ত সড়কটি কাতারের আমীরের নামে নামকরণ করা হচ্ছে। রোববার আমীরের সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন মঙ্গলবার নিজে উপস্থিত থেকে এ দুই স্থাপনা উদ্বোধন করবেন কাতারের আমীর। 

বর্ণাঢ্য আয়োজনে আমীরকে বরণ: গুরুত্বপূর্ণ ওই অতিথিকে লাল গালিচা সংবর্ধনায় বরণ করা হয়। বিমানবন্দরে আমীরের অবতরণের সময় ২১বার তোপধ্বনিতে স্বাগত জানানো হয়। পরে আমীরকে অস্থায়ী অভিবাদন মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে সেখানে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। পরে কাতারের আমীর প্যারেড পরিদর্শন করেন। প্রেসিডেন্ট  মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন কাতারের আমীরকে প্রেজেন্টেশন লাইনে অপেক্ষমাণদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমীরও কাতারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টকে পরিচয় করিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. নসরুল হামিদ বিপু, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিবগণ এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে আমীর ঢাকা সফর করছেন। আজ সকালে কাতারের আমীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শিমুল হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন তিনি। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে ছয়টি চুক্তি এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের প্রস্তুতি রয়েছে।

যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্বৈত কর ও কর ফাঁকি পরিহার, আইনি বিষয়ে সহযোগিতা, সমুদ্র পরিবহন, পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা, দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের স্থানান্তর এবং একটি যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত চুক্তি এবং শ্রমশক্তি, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতাসহ পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিকতা  শেষে আমীর যাবেন বঙ্গভবনে। সেখানে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন কাতারের আমীরের সম্মানে একটি মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেছেন। বাংলাদেশে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সফরকে ‘বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখছে সরকার। সফরটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আগের দিন বলেন, সফরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ কাতার হচ্ছে পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ সর্বোচ্চ গড় মাথাপিছু আয়ের দেশ। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক মধ্যস্থতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত কাতার।

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজারও, যেখানে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। পাশাপাশি এই সফর একটি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের উৎস হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। স্বাধীনতার পর থেকেই কাতার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক দিনের। কাতার বঙ্গবন্ধুকালীন সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্র। ২০২৩ সালে কাতার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আবারো সুদৃঢ় হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কাতারের মহা মুহিম আমীরের বাংলাদেশ সফর। সমপ্রতি কাতারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগ এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি, জ্বালানি, বিমান চলাচল, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কাতারের আমীরের সফরে বাংলাদেশে ইকোনমিক জোন করে দেয়ার প্রস্তাব রাখা হবে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের সিরামিক আছে, আমাদের গার্মেন্ট প্রোডাক্ট আছে, আমাদের আরও অনেক এক্সপোর্ট আইটেম আছে, এগুলো রপ্তানি বাড়ানোর জন্য বলবো। এ ছাড়া আমাদের ওষুধ আছে। এগুলো এখনো রপ্তানি হয়, এগুলোর ভলিয়মটা আরও বাড়ানোর জন্য বলবো। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যাতে তাদের ইনভেস্টমেন্ট হয়, বিশেষ করে আমাদের ইকোনমিক জোনে যাতে তাদের ইনভেস্টমেন্ট হয়- সেটাও আলোচনা করবো। আমরা বিনিয়োগ চাইবো, কাতার তো নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, অর্থনৈতিক সেক্টরে বিনিয়োগ করতে পারে। 

আমীরের সফরে যা যা চাইছে বাংলাদেশ: প্রায় দুই দশক পর কাতারের কোনো আমীর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটিই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর। সব মিলিয়ে কাতারের আমীরের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এই সফর থেকে বাংলাদেশ ঠিক কী অর্জন করার প্রত্যাশা করছে? তার একটি প্রাক্কলন করেছে বিবিসি বাংলা। তাতে বলা হয়, রোববার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশে এনার্জির মজুত আরও বাড়ানো তথা এনার্জি সিকিওরিটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কাতারের আমীরের সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

কাতার মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি শ্রমবাজার। জ্বালানি আমদানি, বিশেষ করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কাতারের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কাতার দিন দিন ‘গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়’ হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়াতে চাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করেন- শ্রমবাজার, জ্বালানিনির্ভরতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমানে কাতারের যে অবস্থান, সব মিলিয়ে দেশটির আমীরের এই সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে কাতারের তখনকার আমীর (বর্তমান আমীরের পিতা) হামাদ বিন খলিফা আল থানি সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

স্মরণ করা যায়, কাতারের বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান মাওয়ানি বাংলাদেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটি মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন বন্দরের ব্যবস্থাপনা করতে চায়। যদিও বাংলাদেশ এখনই প্রতিষ্ঠানটিকে এ বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে মাওয়ানি কাতারকে যুক্ত রাখার প্রেক্ষাপটে এ সফরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানা গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন- বন্দর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাতারের বিশ্বব্যাপী সুনাম আছে। কাজেই তারা যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়, সেটি অবশ্যই ভালো খবর।