এডিবি’র ঋণের মেয়াদ শেষ হলেও বসেনি দুই হাজার সোলার পাম্প

৪০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১৮ সালের মে মাসে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। পরবর্তীসময়ে মোট ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করতে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক সীমা নির্ধারিত ছিল। প্রায় সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ। আর শুধু সোলার স্থাপন কাজের বাস্তব অগ্রগতি মোট প্রকল্পের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এডিবি’র ঋণের মেয়াদ শেষ হলেও বসেনি দুই হাজার সোলার পাম্প
দেশে দেড়শ সোলার পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশে সৌরবিদ্যুৎচালিত দুই হাজার সেচ পাম্প স্থাপন করতে চায় সরকার। এর মাধ্যমে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে ১৯ দশমিক ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাপ কমবে। ডিজেলচালিত পাম্প পরিহারের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে ১৩ হাজার ৬২৪ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানো যাবে।

এসবই ছিল পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা সামনে রেখে ৪০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১৮ সালের মে মাসে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। পরবর্তীসময়ে মোট ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করতে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক সীমা নির্ধারিত ছিল। প্রায় সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ। আর শুধু সোলার স্থাপন কাজের বাস্তব অগ্রগতি মোট প্রকল্পের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মোট অর্থায়নের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৩২৪ কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। মার্চ ২০২২ পর্যন্ত এডিবি থেকে অবমুক্ত হয়েছে মাত্র ২২ কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, যা এডিবির প্রতিশ্রুত মোট অর্থের ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। প্রকল্পের প্রধান কাজ সোলার পাম্প কেনা এবং স্থাপনের কাজের অগ্রগতি না থাকায় এডিবি থেকে অর্থ অবমুক্তি কম হয়েছে।

‘সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে কৃষি সেচ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প’র নিবিড় পরিবীক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডি’র প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিবির ঋণ ও অনুদান ক্লোজিংয়ের সর্বশেষ তারিখ ২০২৩ সালের ৩০ জুন। এ কারণে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এই মেয়াদ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে গত ২৯ মে এডিবিকে পাঠানো হয়েছে। তবে এডিবি এর কোনো জবাব দেয়নি।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নানা কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতি হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহক মিলছে না। এই প্রকল্পের আওতায় পাম্প কিনতে হলে গ্রাহককে ৩৫ শতাংশ টাকা পরিশোধ করতে হবে আর বাকি ৬৫ শতাংশ দেবে সরকার।

গ্রাহকের অংশের এই টাকার মধ্যে গ্রাহককে ১০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। এই ১০ শতাংশ ডাউন্ট পেমেন্টের পর বাকি টাকা ১০ বছরে পরিশোধ করা যাবে। তবে পাম্প চোখে না দেখে টাকা পরিশোধের ঝুঁকি অনেক গ্রাহক নিতে চান না। প্রকল্পের আওতায় সর্বনিম্ন তিন হর্স পাওয়ারের সোলার পাম্পের দাম ১০ লাখ টাকা। এখানে গ্রাহককে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর সর্বোচ্চ ১৫ হর্স পাওয়ারের সোলার পাম্পের দাম ৩০ লাখ টাকা।

প্রকল্পটি সমসাময়িক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে নেওয়া হলেও এডিবি ঋণ ক্লোজিংয়ের কারণে অনিশ্চয়তায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ইআরডির মাধ্যমে এডিবিকে চিঠি দিলেও তা এখনো সুরাহা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে। ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  বলেন, প্রকল্পটি সমাপ্ত করার জন্য ঋণ ও অনুদানের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করতে এডিবিকে অনুরোধ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এডিবি থেকে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। গত মে মাসে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এডিবি বিষয়টি রিভিউ করছে। সংস্থাটি বিভিন্ন তথ্য চেয়েছে, আমরা তাদের তথ্য দিয়েছি।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড জানায়, প্রকল্পের আওতায় পাম্প কেনা হবে ইতালি থেকে এবং সোলার প্যানেল কেনা হবে চীন থেকে। ঠিকাদাররা নানা কারণে এসব সরঞ্জাম দেশে পৌঁছে দিতে দেরি করেছে। এসব কারণেও প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

প্রকল্পের পরিচালক সাকিল ইবনে সাঈদ বলেন, নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হয়েছে। আমরা সময়মতো গ্রাহক পাইনি। সোলার ও পাম্প না দেখেই গ্রাহককে টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্যান্য প্রকল্পে গ্রাহকের পেমেন্ট থাকে না। কিন্তু এই প্রকল্পে গ্রাহকের পেমেন্ট আছে। এ কারণে গ্রাহক পেতে সমস্যা হচ্ছে। আইএমইডি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইএমইডি যা যা চেয়েছে সব কিছুর জবাব দেওয়া হয়েছে। দেড়শ সোলার পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। বাকিগুলোও আশা করি বাস্তবায়ন করা হবে।

আইএমইডি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই ২০১৮ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয় এবং ডিসেম্বর ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত পুনঃনির্ধারিত হয়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২২ পর্যন্ত মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। ভৌত অগ্রগতির হার ৩০ শতাংশ, যা উল্লেখযোগ্য হারে কম।

আইএমইডি সমীক্ষাকালে সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রকল্পের উপকারভোগী নির্বাচনের কাজ এখনো চলমান। এ যাবত ৫১২ জন কৃষকের আবেদন চূড়ান্ত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ফিজিবিলিটি স্টাডি চলাকালে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক কৃষক পাম্প কেনায় আগ্রহ প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে তারা সেচ পাম্প বাস্তবে দেখতে না পাওয়া, কোভিড-১৯ সহ বিভিন্ন কারণে কৃষক পাম্প কেনায় অনীহা প্রকাশ করেন। এ কারণে উপকারভোগী কৃষক নির্বাচনে বিলম্ব হয়। এর প্রভাব প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতির ওপরও দেখা যায়।

প্রকল্পের প্রধান কাজে অর্থ ব্যয়ের অগ্রগতির পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রশিক্ষণ খাতে এ যাবত ব্যয় মোট বরাদ্দের মাত্র ০ দশমিক ২৪ শতাংশ। দুই হাজার সোলার পাম্প স্থাপন কাজে এ যাবত ব্যয়ের পরিমাণ মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং শুধু সোলার স্থাপন কাজের বাস্তব অগ্রগতি মোট প্রকল্পের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

পাম্প স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হলে দুই হাজার কৃষকের সবাইকে পাম্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। প্রকল্পের প্রধান কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ না হওয়ায় প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী ১৯ দশমিক ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার পাম্পসমূহ স্থাপন এবং ১৩ হাজার ৬২৪ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানো সম্ভব হয়নি।

আইএমইডি প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, প্রথম পর্যায়ে ৭০৫টি পাম্প জুন ২০২২ এর মধ্যে সংগ্রহের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। অথচ গ্রিড সংযোগসহ কাজটি সম্পন্ন হতে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হবে। ঠিকাদারের সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের পর আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে বাকি ১ হাজার ২৯৫টি পাম্প স্থাপনের কাজ ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। ৬ জুন ২০২২’র মধ্যে ১ হাজার ২৯৫ সেট সোলার পাম্প সরবরাহ করার কথা। কিন্তু ঠিকাদারের অনুরোধে সরবরাহ ও স্থাপনের শিডিউল চারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই প্রকল্পের কাজে ধীরগতি হয়েছে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়েছে। এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খাত। সারাবিশ্ব সৌরশক্তির পেছনে ছুটছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বা দুই হাজার সোলার পাম্প বসানো গেলে লোডশেডিংয়ের প্রকটতা কমতো। কৃষি খাত অনেক উপকৃত হতো। প্রকল্পটি সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। নানা প্রকল্পে অনিয়ম ও অদক্ষতা দেখা যায়। এই প্রকল্পেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটলো না। এটা এমন কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, সোলার প্যানেল মাত্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মনোযোগ দিলে এমন হতো না।

প্রকল্পের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক স্থাপনা, ডিজাইন, সাপ্লাই, ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিশনিং (টার্নকি), গ্রিড ইন্টিগ্রেশনসহ সৌর সেচ পাম্পিং সিস্টেম এবং যানবাহন কেনা। সোলার পাম্পিং সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ৬০ জন প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ এবং ব্যবহারকারী পর্যায়ের সুবিধাভোগীদের ২০০ জনকে এনার্জিভিত্তিক জীবিকার সুযোগ তৈরি করা হবে। ২০০ জনকে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom