আকাশপথেও অবরোধের প্রভাব, কমেছে যাত্রী-টিকিট বিক্রি

গত বছরের তুলনায় আকাশপথে টিকিট বিক্রি ৪০ শতাংশ কমেছে।

আকাশপথেও অবরোধের প্রভাব, কমেছে যাত্রী-টিকিট বিক্রি

প্রথম নিউজ, ঢাকা: সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পর লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে আসছে দলটি। জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির সঙ্গে পালন করে আসছে এসব কর্মসূচি। সড়ক, নৌ ও রেলপথে সর্বাত্মক অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পণ্য পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থায়। প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের আকাশপথেও। টানা অবরোধে দেশের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফ্লাইটে যাত্রী কমেছে। তবে যাত্রী কমলেও কোনো ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি। এমনকি বাতিলও হয়নি কোনো ফ্লাইট।

দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করা এয়ারলাইন্সগুলোর দাবি, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর টানা অবরোধের কারণে আকাশপথে প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ২০ শতাংশ যাত্রী কমেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে যাত্রী সংখ্যা আরও কমবে। অথচ নভেম্বরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রীর চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত কোনো ফ্লাইটই ফাঁকা যায় না।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এ বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোর, রাজশাহী, বরিশাল রুটে শতাধিক ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা।

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পর্যটন স্থানগুলোতে ভিড় থাকে পর্যটকদের। প্রতি বছরের এ সময় ভ্রমণ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তুতি থাকে পর্যটকদের। সে কারণে অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়কে অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পর্যটন স্থানগুলোও এ সময়ে পর্যটকদের অপেক্ষায় থাকে, প্রস্তুতি থাকে ভালো ব্যবসা করার। কিন্তু এবার বিপরীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের। পর্যটনের পিক মৌসুমে রাজনৈতিক অস্থিরতা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তাদের কপালে।

এর প্রভাব পড়েছে এয়ারলাইন্সগুলোতেও। অবরোধের কারণে পর্যটন গন্তব্যে ভ্রমণ কমেছে, কমেছে এয়ারলাইন্সগুলোতে অগ্রিম টিকিট বুকিং। অবরোধের কারণে পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যাত্রী তুলনামূলক বেশি কমেছে বলে স্বীকারও করেছে এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের আগে অভ্যন্তরীণ রুটে যে পরিমাণ যাত্রী ছিল, এখন তার থেকে গড়ে ১৫ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেটে যাত্রী অনেক কমছে। তবে যাত্রী কমলেও কোনো গন্তব্যে ফ্লাইট কমেনি বা বাতিলও হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ইউএস-বাংলা দিনে অভ্যন্তরীণ রুটে ৭০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে। এসব ফ্লাইটে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টিকিটের প্রচুর চাহিদা থাকে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই টিকিট বুকিং হয়ে যেতো। এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে দেশি অ্যাভিয়েশন খাতে আরও লোকসান হবে।’

কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সাতটি গন্তব্যে দিনে ২৩ থেকে ২৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করে বেসরকারি এয়ারলাইন্স নভোএয়ার। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মেসবাউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধের কারণে আকাশপথে সরাসরি প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে পর্যটন গন্তব্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ যাত্রী কমেছে। ফলে নভোএয়ারের একাধিক অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট কমাতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।’

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব রুটের (কানাডা ও যুক্তরাজ্য ছাড়া) টিকিটে ১০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এরপরও পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রুটে তেমন সারা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বিমান সূত্র।

এ বিষয়ে জানতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে বেসরকারি এয়ারলাইন্সের মতো বিমানেরও যাত্রী কমছে। অবরোধে ভয়ে অনেকে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। আবার এখন স্কুলে সমাপনী পরীক্ষা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না, এমনটাই ধারণা করছি। তাই আর এক-দুই সপ্তাহ দেখে হয়তো ফ্লাইটের সংখ্যা কমাতে হবে।’

আগামী ১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে আকাশপথে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা মোস্তফা কামাল। তিনি বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রোববার (১২ নভেম্বর) ফকিরাপুল এলাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের টিকিট কাটেন।

আলাপকালে মোস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রতি বছরের ডিসেম্বরে স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাই। এবারও যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। কিন্তু এখন দেশে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি, তাতে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনটি হলে টিকিট বাতিল করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

দেশে ট্রাভেল এজেন্টদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। সারাদেশে সংগঠনটির সাড়ে তিন হাজার সদস্য রয়েছে। দেশ-বিদেশে অ্যাভিয়েশন ও পর্যটন খাতের সুষ্ঠু উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সংগঠনটি।

হরতাল-অবরোধে অভ্যন্তরীণ রুটে উড়োজাহাজ টিকিট কেমন বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে সংগঠনটির মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, ‘সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মানুষ পরিবার নিয়ে দেশ-বিদেশে পর্যটন এলাকাগুলোতে বেড়াতে যায়। কারণ, এ সময় স্কুল-কলেজ ছুটি থাকে। কিন্তু এখন হরতাল-অবরোধে মানুষ আতঙ্কে আছে। ভয় নিয়ে কেউ বেড়াতে যায় না। ফলে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এখন এয়ারলাইন্স টিকিট বুকিং গড়ে ৪০ শতাংশ কমেছে। এতে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’