বছর জুড়েই অস্থিরতা, আগামীতে দুশ্চিন্তা
বছরজুড়েই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। নিত্যপণ্যের বাজার ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য আতঙ্কের।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বছরজুড়েই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। নিত্যপণ্যের বাজার ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য আতঙ্কের। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটাসহ বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম। দাম বাড়ার পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের চেয়ে ব্যবসায়ীদের অবৈধ সিন্ডিকেট কাজ করেছে বেশি। সরবরাহ বন্ধ রেখে ভোজ্য তেল ও চিনির দাম বাড়াতে সরকারকে রীতিমতো বাধ্য করেছিল ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক নয় বরং দ্রব্যমূল্য ইস্যুতেই চাপের মুখে ছিল সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন, হুঁশিয়ারি-সাবধানী করেছেন। কিন্তু তার কথা কেউ পাত্তা দেয়নি। বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই মনে করছেন সাধারণ মানুষ। আর কেউ কেউ মনে করছেন মন্ত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
জ্বালানি সংকটে জুলাই-এপ্রিলে লোডশেডিং তীব্র হলে নিত্যপণ্য পাগলা গোড়ার মতো বাড়তে থাকে। সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার দাবি করেছে, তবে সেটি মানতে নারাজ বিশ্লেষকরা।
বিবিএসের হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৯১ শতাংশে নেমেছে। এর আগে আগস্ট মাসে ৯.৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়, যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরে সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯.১০ শতাংশে নেমেছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০.২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি।
বছরের মাঝামাঝি এক বৈঠকে কৃষি সচিব জানান, বিভিন্ন হাত বদল হওয়া এবং চাঁদাবাজির কারণে শাক-সবজির দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী হুমকি দেন বাজার মনিটরিং করা হবে, অধিক দামে বিক্রি করা হলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ ছিল না। দিশাহারা অবস্থায় টিসিবি’র দিকে নজর দেয় সাধারণ মানুষ। কিন্তু টিসিবি’র মধ্যেও নানা সমস্যা ক্রমশ মানুষকে অস্থির করে তুলে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে না ধরলে সামনের রমজানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চালের বাজার: বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই দেশে চালের বাজারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ায় চালের অন্য দেশের চেয়েও বাংলাদেশে বৃদ্ধির হার কয়েক গুণ বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে গত দুই বছরে চালের দাম কমেছে। বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বরে রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের (স্বর্ণা/চায়না/ইরি) দাম ছিল ৪৫-৪৬ টাকা। বর্তমানে বেড়ে ২০২২-এর নভেম্বরে তা ৫৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সে হিসেবে এ সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ১৯.৫৬ শতাংশ। টিসিবি’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খোলাবাজারে মোটা চালের দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সরু মিনিকেট চাল ৭৫ ও মাঝারি চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৮শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের মজুত রয়েছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৫২ টন। এর মধ্যে চলতি বছরের ১লা জুলাই থেকে ২৮শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট চাল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার টন।
আটা-ময়দা: ২০২১ সালের শেষে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। এখন কিনতে হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। একইভাবে ময়দার দাম ৪০-৪২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ দুই পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। টিসিবি’র তথ্য বলছে, বিগত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে ময়দার দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত।
তেল-চিনি: তেল ও চিনির দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। আবার বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। টিসিবি বলছে, বাজারে পৃষ্ঠা ২ কলাম ৬
সয়াবিন তেলের দাম এখন গত বছরের তুলনায় সাড়ে ২২ শতাংশ বেশি। আর চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ। গত বছর এক কেজি চিনির দাম ৭৫ টাকার মধ্যে থাকলেও সেটি এখন ১১৫ টাকা।
ডালের বাজার: নভেম্বর থেকে বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। খুচরা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডালের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। টিসিবি’র হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে বড়, মাঝারি ও ছোট দানার মসুর ডালের দাম কেজি যথাক্রমে ১৫, ২৪ ও ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৯৭ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। বাজারে খোলা মসুর ডালের পাশাপাশি সুপারশপ বা বড় দোকানে প্যাকেটজাত ডাল পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত মসুর ডাল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ১২০ টাকার মধ্যে ছিল।
সবজি-মাছ-মাংস: ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত বছরব্যাপী চড়া ছিল সবজির দাম। গরুর মাংসের দাম এক বছরের ব্যবধানে একশো-দেড়শো টাকা বেড়েছে। সঙ্গে চড়া ছিল সব মাছের দাম-ই। বছরের বেশির ভাগ সময় ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি কেনা যায়নি। একইভাবে বছরের মাঝামাঝি এসে অন্য মাছের মতো সবচেয়ে কম দামি মাছ পাঙ্গাশের দামও বেড়েছে। চাষের পাঙ্গাশ এখন ১৮০ টাকা, দর বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার মতো। তেলাপিয়া ১৮০ টাকায় পাওয়া যেতো, সেটা এখন ২২০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তি।
জ্বালানি সংকটে জুলাই-এপ্রিলে লোডশেডিং তীব্র হলে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা বাড়ে। সোনালি মুরগি বিক্রি হয় ৩২০ টাকায়। ৫০ টাকা বেড়ে ডিমের ডজন দাঁড়ায় ১৬০ টাকায়।
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বসবাস করেন শাজাহান মিয়া। তার মতে, আয় দিয়ে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু নিত্যপণ্যের পাগলা ঘোড়া দিশাহারা করে তুলেছে তাকে, এখন জীবন বাঁচানোই দায়। দাম বাড়ার পরে আয় তো দূরের কথা, খাবার একবেলা জুটলে আরেক বেলায় জুটে না।
বাসা বাড়িতে রান্নার কাজ করেন সুফিয়া বেগম। তিনি বলেন, দাম বাড়ার কারণে খাবারের পরিমাণ কমাতে হয়েছে। বাজারের কথা উঠলে ভয় হয়। ডাল-ভাত খেয়ে যখন যা জোটে তা খেয়ে কোনোভাবে দিন কাটে।
জানা গেছে, চলতি বছর নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে কোণঠাসা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ও এর প্রভাবে বাংলাদেশে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানিতে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রপ্তানি আদেশে বাধা এবং জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বেকায়দায় পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি বা ওএমএস কার্যক্রমের ট্রাক সেলের লাইনে কয়েকদিন আগেও ভিড় ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের। সেই চিত্র এখন বদলেছে। এখন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ একই লাইনে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২২ সাল ভোক্তাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের বলেন, জনগণের পকেট কাটার জন্য উৎসবে মেতে ওঠে তারা। বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে তারা দাম বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট থেকে শুরু করে ডলারের সংকট হয়েছে সেটা সত্য। তবে সেসব কারণ দেখিয়ে যে হারে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে সেটা বেশি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews