নদীতে মিলছে না ইলিশ
পরিস্থিতি এমন-নদনদীতে ইলিশ ধরা প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছেন জেলেরা।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বছরজুড়ে নানা নিষেধাজ্ঞার ফলে ইলিশ ধরা হয় না। উৎপাদন বাড়ার আশায় সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয় সবাই। কি কারণে ইলিশের বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে না তা তারা জানে না। যখন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তখন কি আসলেই ইলিশের প্রজনন মৌসুম নাকি আগে বা পড়ে! উত্তরে কালাবদর নদ থেকে দক্ষিণে সাগরমোহনার বলেশ্বর নদী-কোথাও মিলছে না মিঠাপানির ইলিশ। আগে যেখানে জাল ফেললেই মিলত মনকে মন ইলিশ, সেখানে এখন সারা দিন চেষ্টা করেও পাওয়া যাচ্ছে না ৪-৫টির বেশি। সাগরপারের পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদীর জেলে জয়নাল মাঝি বলেন, ‘৪-৫ বছর আগেও একবেলা জাল ফেললে পেতাম ২৫-৩০টি ইলিশ। এখন সারা দিন বসে থেকেও ৩-৪টির বেশি মেলে না।’ নদনদীতে ইলিশের এই সংকট এখন পুরো দক্ষিণাঞ্চলে। সাগরের ইলিশে মোকাম ভরলেও মিলছে না জগদ্বিখ্যাত মিঠাপানির সুস্বাদু ইলিশ। যাকে বিলুপ্তির শঙ্কা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সুস্পষ্ট ৪টি কারণকে দায়ী করছেন তারা। এসব সমস্যার সমাধান না হলে ভবিষ্যতে মিঠাপানির ইলিশ বলে দেশে আর কিছুই থাকবে না বলছেন তারা।
গবেষণা সংস্থা ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের নির্বাহী পরিচালক আবিদুর রেজা বলেন, ‘মিঠাপানির ইলিশের জন্যই বিখ্যাত বাংলাদেশ। ডিম পাড়ার সময় হলে লবণাক্ত সাগর ছেড়ে নদনদীর গভীরে প্রবেশ করে উজানঠেলা ইলিশ। বিপরীত স্রোতে দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে মিঠাপানির ঘর্ষণে শরীরে চর্বির একটা আস্তর পড়ে। এই চর্বির কারণেই বাড়ে ইলিশের স্বাদ। যে স্বাদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।’
বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল বলেন, ‘বর্তমানে সাগরের যে ইলিশ আসছে, তাই-ই বাজারে দিচ্ছি। তবে এই ইলিশের চাহিদা কম। সবাই চায় নদীর ইলিশ। সেই ইলিশ পাব কোথায়? পরিস্থিতি এমন-নদনদীতে ইলিশ ধরা প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছেন জেলেরা।’
কেন মিলছে না মিঠাপানির ইলিশ-জানতে কথা হয় বয়োবৃদ্ধ মৎস্য ব্যবসায়ী বরিশাল মোকামের মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। সংকটের জন্য অবাধে জাটকা শিকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘বাজারে চাপিলা নামে যে মাছটি বিক্রি হয়, সেটি আসলে ছোট ইলিশ। সরকার এবং মৎস্য বিভাগ জাটকা নিধন প্রতিরোধে কাজ করলেও চাপিলা নামে যে লাখ লাখ টন ইলিশের বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে, সেদিকে কোনো নজর নেই। বরিশালের তালতলীতেই টনকে টন চাপিলা বেচাকেনা হয় প্রতিদিন। চাপিলা বাঁচানো না গেলে বাঁচবে না মিঠাপানির ইলিশ।’
বরগুনা জেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘ইদানীং নতুন একধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে মাছ শিকার করছেন অসাধু জেলেরা। ওই রাসায়নিক পানিতে ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভিড় করে। এক্ষেত্রে ছোট-বড় কিংবা পোনার কোনো ভেদাভেদ না রেখেই তা শিকার ও বিক্রি করেন জেলেরা। এর সঙ্গে রয়েছে খুঁটা বেড়া আর চায়না দুয়ারিসহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক জালে মাছ শিকার। এসব কারণেই নদনদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ইলিশ।’
অভিজ্ঞ জেলে আর ইলিশ ব্যবসায়ীদের এসব বক্তব্য নিয়ে কথা হয় মৎস্য বিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমানের সঙ্গে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউিটের সদ্য সাবেক এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলেরা যা বলছেন, তা সংকটের একটি কারণ হলেও প্রধান নয়। কেবল বরিশাল অঞ্চল যদি ধরেন, তাহলে এই অঞ্চলের রয়েছে ৭টি নদীমোহনা। এ নদীগুলো দিয়েই মূলত সাগর থেকে অভ্যন্তরভাগের পদ্মা, মেঘনাসহ অন্যান্য নদীতে আসে ইলিশ। সাগরের কম স্বাদের ইলিশ মিঠাপানির সংস্পর্শে এসে পায় দুর্দান্ত স্বাদ তৈরির উপকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে এসব নদীমোহনায় জেগেছে অসংখ্য চর-ডুবোচর। যে কারণে নদনদীতে ঢুকতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ইলিশের ঝাঁক। আরেকটি কারণ হচ্ছে-নদীমোহনায় শিল্পায়ন। বরগুনার তালতলীতে নির্মিত হয়েছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এই কেন্দ্র নির্মাণে লাখ লাখ টন বালু তোলা হয়েছে তিন নদী-বিশখালী, বলেশ্বর ও পায়রার মোহনা থেকে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে, তেমনই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিত আসা কয়লাবাহী জাহাজের চলাচল ও কেন্দ্র চালু থাকাবস্থায় সৃষ্ট কম্পনেও বিঘ্নিত হচ্ছে ইকো সিস্টেম। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে বুড়াগৌরাঙ্গ আর আগুনমুখা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে। এখন আপনি যদি ইলিশের বিচরণক্ষেত্র তথা চলাচলের পথেই বাধা দেন, তাহলে মিঠাপানি অর্থাৎ নদনদী ইলিশশূন্য হবে-সেটাই স্বাভাবিক। শিল্পায়নের দূষণ আর উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে নদনদীতে যে চর-ডুবোচরের সমস্যা, তা দূর করা না গেলে মিঠাপানির ইলিশের সংকট কখনোই কাটবে না।’
সংকটের জন্য মাছের প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে ত্রুটির কথাও বলেন এই মৎস্য বিজ্ঞানী। ভারতে প্রজনন মৌসুমের সময়কাল মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একই সমুদ্রে খুব কাছাকাছি পানিসীমায় আমরা দুই দেশ। অথচ আমাদের পানিসীমায় প্রজনন মৌসুম নির্ধারিত হয়েছে ১৫ জুন থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত। এখানে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি রয়েছে। দুই দেশের সময়সীমা তো একই হওয়ার কথা। এর ওপর আমরা হরহামেশা অভিযোগ শুনি-আমাদের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বাংলাদেশের পানিসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায় হাজার হাজার ভারতীয় ট্রলার। এসব কারণেও কমে যাচ্ছে মিঠাপানির ইলিশ।’
বরিশালের ইলিশ ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, ‘বছরজুড়ে নানা নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বন্ধ থাকে ইলিশ শিকার। আমরাও মেনে নিই উৎপাদন বাড়বে আশায়। সব মেনে যদি এই অবস্থা, তাহলে নানা অজুহাতে আমাদের নদীতে নামতে বাধা দিয়ে কী লাভ?’ বিষয়টি সম্পর্কে আলাপকালে বরিশালের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘মৌসুমের শুরু বলে নদনদীতে ইলিশ একটু কম। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এই সংকট কেটে যাবে। তাছাড়া নদীমোহনায় চর-ডুবোচর, অবৈধ জাল ব্যবহার এবং পরিবেশ দূষণও সংকটের সৃষ্টি করছে। আশা করছি, এ সংকট বেশি দিন থাকবে না।’