ছোট কর্মকর্তার বড় দুর্নীতি, স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ১২৬ কোটি টাকা লেনদেন
মঙ্গলবার ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন : একটি সরকারি সংস্থার সহকারী পরিচালক (এডি) মো. আকরাম হোসেন তিনি টাকার মেশিন! বর্তমানে তিনি সাকুল্যে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। অথচ স্ত্রীর নামে তৈরি করা তিনটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ১৫ বছরে লেনদেন করেছেন ১২৬ কোটি টাকা। ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি ছয়টি ব্যাংকের ২৫টি অ্যাকাউন্টে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিপুল অঙ্কের এই লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা যায়, দেশের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানায় যেসব বিদেশি কর্মী কাজ করেন, তাদের জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সংস্থাটির যে ডেস্ক থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়, ওই ডেস্কে দায়িত্ব পালনের সুযোগে অবৈধ পথে বিপুল অর্থ রোজগার করেন আকরাম হোসেন। আর এ অর্থ বৈধ করার জন্য তিনি স্ত্রীর নামে স্টার ইলেকট্রো ওয়ার্ল্ড, স্টার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও স্টার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের তিনটি বেনামি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বেসিক ব্যাংক কাওরান বাজার শাখা, ইস্টার্ন ব্যাংক শান্তিনগর, ইসলামী ব্যাংক মিরপুর, উত্তরা ব্যাংক রোকেয়া সরণি, পূবালী ব্যাংক মিরপুর ও ইউসিবি ব্যাংক মিরপুর শাখায় ২৫টি হিসাব খুলে লেনদেন করেন। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এসব হিসাব নম্বরে জমা হয় ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ১৪৪ টাকা। আর উত্তোলন করা হয় ১২৫ কোটি ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৪ টাকা।
দুদক কর্মকর্তা বলেন, আকরাম হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন একজন আয়করদাতা। তিনি ২০০৯-২০১০ করবর্ষ থেকে আয়কর দিয়ে আসছেন। ২০০৯-১০ করবর্ষে তিনি নিট সম্পদ ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭০ টাকা উল্লেখ করেছেন। সম্পদবিবরণী ও আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী তিনি স্টার ইলেকট্রো ওয়ার্ল্ড নামীয় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল অঙ্কের এ টাকা লেনদেন অস্বাভাবিক। একজন সরকারি চাকরিজীবীর স্ত্রীর নামে খোলা বেনামি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এমন লেনদেন সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হয়।
আকরাম যেসব স্থাবর সম্পদ কিনেছেন, এর বেশির ভাগই নিজের জন্মস্থান নাটোর এলাকায়। ২০০২ সালে নাটোর সদরের নওপাড়া মৌজায় ২৭ শতাংশ কৃষিজমি দিয়ে তিনি জায়গা-জমি কেনা শুরু করেন। পরের মাসেই তিনি আরও ৭ শতাংশ জমি কেনেন। এরপর ২০০৩ সালে একই মৌজায় ২১ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৭ শতাংশ, ২০০৭ সালে ঢাকার দক্ষিণখানে আড়াই শতাংশ, ২০১৪ সালে সেন্টমার্টিনের জিনজিরা দ্বীপ মৌজায় ২০ শতাংশ, নাটোরের নওপাড়া মৌজায় ৪ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ১৪৮২ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনেন। ২০১৫ সালে তার সম্পদের অনেকটা বিস্ফোরণ ঘটে। ওই বছর তিনি নাটোরে আরও ৩২ শতাংশ, সাভারে ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ জায়গা কেনেন। সাভারের এ জায়গায় অন্তত ৬ কোটি টাকা খরচ করে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। ২০১৬ সালে নাটোরে দুই দফায় ৭১ শতাংশ জমি এবং মিরপুরে ১০০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান কেনেন। ২০২০ সালে আবারও নাটোরে দুই দফায় যথাক্রমে ১১ শতাংশ ও দশমিক ২৯৬০ একর ধানি জমির মালিক হন আকরাম। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তার নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ৩৯ লাখ ১৭ হাজার ৭০৬ টাকা। আর স্ত্রী সুরাইয়া পারভীনের নামে ঢাকার মিরপুর সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় তিন ফ্ল্যাট, নাটোরে ১৫ শতাংশ জমি, একটি টয়োটা ফিল্ডার মডেলের গাড়িসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পুঁজি রয়েছে।
জানা যায়, যাচাই-বাছাই শেষে আকরাম দম্পতির অবৈধ ৬ কোটি ৯১ লাখ ৩২ হাজার ৯১৩ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পেয়েছে দুদক। অসাধু উপায়ে অর্জিত ও জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এ সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে রাখার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় দুর্নীত দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলা ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে জানতে আকরাম হোসেনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।