৪ মাসে ৫০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাজারের সংকট কাটাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৪ মাসে ৫০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও ডলারের সংকট কাটছে না। এতে চরম বিপাকে ব্যবসায়ীরা। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও জরুরি জিনিসপত্র যেমন- জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকেই কেবল ডলার দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার পাচ্ছে না। জরুরি জিনিসপত্র আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। অন্যান্য খাতের সঙ্গে ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে।
ফলে রিজার্ভ আরও কমেছে। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫.৭ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগের চেয়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার কম। গত বছরের ২রা নভেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬.৪৯ বিলিয়ন ডলার।
তার আগে ১২ই আগস্ট অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। ডলার সংকটে বিপাকে পড়া একটি প্রতিষ্ঠান জানায়, তারা সাধারণত আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে ঋণপত্র বা এলসি খুলে। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খোলার জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না তারা। এ ছাড়া অনেকেই ব্যাংকে আমানত রাখার পরিবর্তে ডলার কিনে মজুত করছেন। জানা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমায় ব্যাংকগুলোর ডলার সংকট আরও বেড়েছে। আমদানি দায় কমাতে নানা উদ্যোগের পরও কাটছে না ডলার সংকট। এর মধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমছে। সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই সেপ্টেম্বরে গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছিল প্রায় ১১ শতাংশ। আর অক্টোবরে কমেছে ৭.৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬.২৫ শতাংশ। অক্টোবরে কমেছে আরও বেশি ৭.৮৫ শতাংশ।
এদিকে এই সংকটের সময়েও সরকারি ঋণপত্রের দেনা মেটাতে কোনো ব্যাংক যেন ব্যর্থ না হয়, সে জন্য নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে ২ কোটি ডলারের মতো। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরে বিক্রি ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে চলতি ২০২২ পঞ্জিকা বছরের এ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০.১৬ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স হ্রাস এবং ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রির ফলে দেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমেই চলেছে। আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। শুধু সরকারি এলসি’র দায় মেটাতে এখন ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় এলসি’র দেনা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দেশে রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে নেমেছে, তাতে ঢালাওভাবে ডলার বিক্রি করলে ঝুঁকিতে পড়তে হবে। যে কারণে এখন আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমদানিতে তদারকি জোরদার, শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নির্ধারণসহ বিভিন্ন উপায়ে এলসি কমানো হয়েছে। এর পরও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১.৬৭ শতাংশ বেশি। পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, আমদানিতে এখনো যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যেভাবে কমছে, সেভাবে কমলে রিজার্ভ আরও নিচে নেমে আসবে। এবারও ব্যালান্স অফ পেমেন্ট এবং পণ্য বাণিজ্যে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে। তাতে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। এদিকে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না।
শুধু যাদের রপ্তানি আয় আছে ও যারা বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক শুধু তাদের ঋণপত্রই খুলছে। তবে অক্টোবরে এসে ঋণপত্র খোলা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ীরা কাপড়ের এলসি খুলতে পারছেন না। রপ্তানি বাড়াতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আনা জরুরি। কিন্তু এ জন্যও ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। বস্ত্র শিল্পের জন্য দেশের বাইরে থেকে তুলা আমদানি করতে হয়। তুলা আমদানি করা না গেলে সুতা তৈরি হবে না। সুতা তৈরি না হলে কাপড় শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কিন্তু তুলা আমদানিতেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। এদিকে বিভিন্ন গুজবে অনেকেই ব্যাংকে আমানত রাখতে ভয় পাচ্ছে। তবে একাধিক এক্সচেঞ্জ হাউজের কর্মকর্তারা মনে করেন, অনেকেই ডলার কিনে মজুত করছেন। কারণ শেয়ারবাজারে আস্থা নেই। তাই এখানে বিনিয়োগের পরিবর্তে ডলার কিনছেন। পরে দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বেচে দেবেন তারা।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews