রাজনীতি নয়, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর পক্ষেই মত
মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের সতর্ক করেছে আ.লীগ। পরিস্থিতি দেখে-বুঝে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সরকার।
প্রথম নিউজ ডেস্ক: নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইস্যুতে কৌশল চূড়ান্ত করতে পারছে না আওয়ামী লীগ। তবে এই বিরোধী নেত্রীকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগের পরিবর্তে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের অধিকাংশ নীতিনির্ধারকের। যদিও আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড আপাতত এ বিষয়ে সবাইকে কথা না বলার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। পরিস্থিতি দেখে-বুঝে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সরকার। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না পারার বিষয় নিয়ে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা দুই ধরনের মন্তব্য করেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, নির্বাহী আদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থগিত করে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার রাজনীতি করা নিয়ে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। যে দুটি শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে বলা ছিল ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। উক্ত সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে আনিসুল হক আরও বলেন, ‘আপনারা যখন প্রশ্ন করেছিলেন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার বিষয়ে কোনো শর্ত দেওয়া হয়েছিল কিনা, এ রকম কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। আমি সত্য কথা বলি। এজন্য সত্য কথা বলেছি।’
একই দিন বিকালে ঢাকায় আরেক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ না হলে কারাগারে থাকতেন, তার রাজনীতি করার সুযোগ নেই। মানবিক কারণে খালেদা জিয়া যেটুকু পেয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতার জন্য পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না-করা নিয়ে দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অস্বস্তি তৈরি হয়। ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড দলটির নেতাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। সেই থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা। মন্ত্রীরাও এখন আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না-করা বা বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন না।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ নিয়ে তারা দলের হাইকমান্ডকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন, বর্তমানে খালেদা জিয়া যেভাবে রয়েছেন, নির্বাচনের সময় সে অবস্থায় থাকলে বিএনপি আরও শক্তিশালী হতে পারে। এমনকি তাকে উপস্থিত করা হতে পারে বিএনপির বড় কোনো সমাবেশ বা কর্মসূচিতে। তখন পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। তাই সেই ঝুঁকি না নিয়ে বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো।
জানা গেছে, এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বর্তমানে সে বিষয়ে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনে কৌশল গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি কতটা সংগঠিত হতে পারবে-দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে তার পরিবারের সদস্যরা আলোচনা শুরু করেন। তখন এ ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন বিএনপি নেতারা। পরবর্তী সময়ে নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত রাখায় কারাগারের বাইরে আসার সুযোগ পান বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়। এখন সংসদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রয়াত উপদেষ্টা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। ওই উপদেষ্টা তখন বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে দরকষাকষির অংশ হিসাবে আলোচনা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ওই নির্বাচনের পর নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মুক্তির পর থেকেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে দলটির নেতারা দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার এতদিন ইস্যুটি ঝুলিয়ে রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হলে তা হবে সরকারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা। এমনকি বিদেশি কূটনীতিকদের চাপও এড়ানো যাবে বলে ধারণা করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না-পারার বিষয়টি হঠাৎ করেই জানুয়ারিতে সামনে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি দাবি করেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা রয়েছে। এক/এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার প্রসঙ্গ টেনে শেখ সেলিম এমন মন্তব্য করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খোদ সরকারি দলের মধ্যেই সেলিমের বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং অনেকে মনে করেন মুক্ত হওয়ার আগে খালেদা জিয়া রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়েছিলেন।
জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা নির্বাহী আদেশে স্থগিত করে ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল তাকে মুক্তি দেয় সরকার। তারপর থেকে পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাস পরপর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।