পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য নিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীদের সাজা!

পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য নিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীদের সাজা!

প্রথম নিউজ ডেস্ক:ঢাকার আদালতে নাশকতার অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে করা মামলার বিচার দ্রুতগতিতে চলছে। প্রতিদিনই বিচারাধীন পুরোনো মামলায় রায় হচ্ছে। রোববার রাজধানীর বিভিন্ন থানার চার মামলায় বিএনপির ৪৬ নেতাকর্মীর সাজা হয়েছে। এনিয়ে গত ৫ মাসে ৯২ মামলায় ১ হাজার ৫১২ জনকে সাজা দেওয়া হলো। এসব মামলার তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সাক্ষী ও বাদী পুলিশ। কমপক্ষে ২৫টি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিচার চলাকালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে রায় দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে আরও অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি মামলার রায় হতে পারে।

আইনজীবীদের দাবি, স্বাধীন সাক্ষী ছাড়া মামলার বিচার কাজ শেষ করে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। আর রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করার জন্যই রায় হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রায় দেওয়া হয়। আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে আরও প্রায় ৪৫০ মামলা। এসব মামলায় আসামির তালিকায় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান থেকে ওয়ার্ডের কর্মী পর্যন্ত রয়েছেন।

বিএনপি নেতাকর্মীদের পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবা জানান, প্রায় ৩০টির অধিক মামলার রায় হয়েছে শুধু বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের সাক্ষী নিয়ে। পুলিশ সদস্যরা মূলত রাষ্ট্রের হয়ে সাক্ষী দেন। আদালতে ন্যায়বিচার হতে হলে অবশ্যই নিরপেক্ষ সাক্ষীর প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের রায়ের ক্ষেত্রে শুধু রায় দিতে হবে তাই তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘সরকার মনে করেছিল সাজা দিলেই বিএনপি নেতাকর্মীরা ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকার ব্যর্থ। কারণ বিএনপি নেতাকর্মীরা এসব রায়ে ভীত নন।’

২০ ডিসেম্বর পল্টন থানায় ২০১৮ সালে নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবসহ ১৯ জনকে ২ বছরের সাজা দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। খালাস দেওয়া হয় ২৫ জনকে।

চলতি বছরের ১৭ মে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছিল আগের বছরের ১৪ নভেম্বর এবং শেষ হয় ৫ ডিসেম্বর। তাদের মধ্যে দুজন এসআই অলিউর রহমান ও নজরুল ইসলাম মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আরেকজন মামলার বাদী এসআই আরশাদ হোসেন। বাকি দুজন কনস্টেবল।

নাশকতার অভিযোগে করা তিন মামলায় গত ২০ ডিসেম্বর বিএনপির ৩৬ নেতাকর্মীকে সাজা দেন আদালত। এরমধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ১৬ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে পূর্ব বাড্ডার আলিফনগর এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনি ক্যাম্পে আগুন দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মোবিনুল ইসলাম বাধন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ১৫ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪ জন। এর মধ্যে একজন মামলার বাদী, একজন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবদুর রশিদ, বাকি দুজন পুলিশ কনস্টেবল। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ বিকালে মিরপুরের পাইকপাড়ায় ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের এসআই ফারুক আহম্মেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলায় গত বছরের ৩১ আগস্ট ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। মামলায় পাঁচজন আদালতে সাক্ষী দেন। তাদের সবাই পুলিশ সদস্য। এ মামলায় ৫ জনকে আড়াই বছর করে সাজা দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত।

২০১৮ সালে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা এক মামলায় রোববার ১০ জনকে ২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ মামলায় ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া হয়। বাদী, তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৫ জনই পুলিশ সদস্য। ২০১৮ সালে সূত্রাপুর থানার আরেক মামলায় বিএনপির ৯ জনকে ২ বছর সাজা দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ১৪ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে ৪ জনের। তাদের সবাই পুলিশের সদস্য। এছাড়া ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০১৮ সালে করা এক মামলায় ১০ জনকে ১ বছর ১ মাস সাজা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। কলাবাগান থানায় ২০১৮ সালে করা এক মামলায় বিএনপির ১৭ জনকে ২ বছর ৬ মাস সাজা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত।

এ সম্পর্কে বিএনপিপন্থি আরেক আইনজীবী হান্নান ভূঁইয়া বলেন, আদালতে আসামি বা বাদী সবারই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে করা মামলার যে রায় দেওয়া হচ্ছে তার মাধ্যমে আদালতে বিচার প্রার্থীরা কোনো ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। আসামিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগটুকুও দেওয়া হচ্ছে না। বাদী ও পুলিশের সাক্ষ্য নিয়ে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। স্বাধীন সাক্ষী ছাড়া মামলার বিচার কাজ শেষ করে দেওয়া আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সাম্প্র্রতিক সময়ে তড়িঘড়ি করে যে রায়গুলো দেওয়া হয়েছে প্রত্যেকটিতেই কোনো লিগ্যাল প্রসিডিওর মানা হচ্ছে না। ৫০ সাক্ষীর মধ্যে ৫ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিষয়ে অধস্তন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু  বলেন, আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করার জন্যই রায় হচ্ছে। কম সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে রায় দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রায় দেওয়া হচ্ছে।