চলমান অবরোধে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গুলি
বেশকিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিরোধী জোটের ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের দ্বিতীয় দিনও দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বেশকিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভৈরবে আগের দিনের সংঘর্ষে পুলিশের টিয়ার শেলে আহত চা দোকানি আশিক মিয়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে মারা গেছেন। এদিকে ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ককটেল হামলা ও ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। দ্বিতীয় দিনও ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে অবরোধের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও মহাসড়কে মিছিল বের করে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। গতকাল মাঠে ছিলেন জামায়াত ও সমমনা জোটের নেতাকর্মীরা। রাজধানীসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জেলায় ঝটিকা মিছিল বের করে। টায়ারে আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন। এতে গতকালও সারা দেশে থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা।
রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার কোনো বাস। রাজধানীতে স্বল্প সংখ্যক গণপরিবহনও চলাচল করলেও রাস্তাঘাট ছিল অনেকটা ফাঁকা। কোথাও কোনো ধরনের যানজট চোখে পড়েনি। এ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িও খুব একটা চলাচল করতে দেখা যায়নি। ওদিকে অবরোধের প্রভাব পড়ে সদরঘাট লঞ্চঘাটেও। যাত্রী সংকটের কারণে লঞ্চ চলাচল করতে দেখা যায়নি।
অবরোধ চলাকালে সংঘর্ষ হয়েছে সিলেটের বন্দরবাজারে। দুপুরে ছাত্রদল ও শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় মোটরসাইকেলে আসা ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধর করে ছাত্রদল কর্মীরা। এদিকে সকালে বগুড়ায় বিজিবি’র সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সকালে শহরের তিনমাথা রেলগেট এলাকায় অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করলে বগুড়া জেলা বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত গুলি চালায় পুলিশ ও বিজিবি’র সদস্যরা। এ সময় রাস্তায় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সংঘর্ষে বিএনপি’র ৫/৬ জন নেতাকর্মী ছররা গুলিতে আহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে দলের তরফে। ওদিকে সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। আড়াইহাজারে গাড়ি ও সিএনজি অটোরিকশা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। রূপগঞ্জের আদুরিয়া এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একটি কাভার্ডভ্যান ভাঙচুর করেছে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে যাত্রীবাহী একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দুপুর ১২টার দিকে পাবনার ঈশ্বরদীর রেলওয়ে জংশনের অদূরে লোকোসেড এলাকায় কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ককটেল হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনটির একটি বগির জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ আহত হয়নি।
দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করে এলডিপি’র নেতাকর্মীরা। পুলিশের ধাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তারা। এ সময় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের দাবি মিছিল থেকে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। অবরোধ সমর্থনে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিল বের করে যুবদল মহানগর দক্ষিণ। এ সময় একটি বাস ও কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সকালে মুগদা মেডিকেল কলেজের সামনের মিডলাইন পরিবহনের বাসে এই আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। বিকালে মিরপুর কাফরুল থানার গেটের সামনে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তিতাস নামে একটি বাসকে ধাওয়া করে বাসের পেছনের দিকে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। সকালে আমিন বাজারে দুটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় শ্যামলী ও বাড্ডার নতুনবাজারে দুটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
এদিকে অবরোধের সমর্থনে বিএনপি’র পাশাপাশি রাজধানীতে মিছিল করেছে জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এনডিপি, লেবার পার্টি, এবি পার্টি, এনডিএম, গণফোরাম রাজধানীতে পৃথকভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সকালে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে রামপুরায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে দলটির নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া যুবদল বিজয়নগর, কাওরান বাজার, মিরপুর, উত্তরা এবং নতুন বাজারে অবরোধের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রামপুরা ব্রিজ, খিলগাঁও, কাকরাইল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মহাখালী, বনানী এবং শনির আখড়ায় সড়ক অবরোধ করে মিছিল করে ছাত্রদল। বিজয়নগর, প্রেস ক্লাব এবং নয়াপল্টনে কৃষক দল, শাহবাগ, ফার্মগেট, সায়েদাবাদ ও গাবতলীতে বিক্ষোভ করে স্বেচ্ছাসেবক দল। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের প্রায় প্রতিটি থানায়ই বিক্ষোভ মিছিল করেছে মহানগর নেতাকর্মীরা।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। এদিকে সকালে বরিশালে অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) বিলকিস জাহান শিরিন ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেনসহ ১০ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শ্যামপুর থানার ৪৭নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি নুরুল ইসলামকে না পেয়ে তার ড্রাইভার মো. সোহেল, কেয়ারটেকার আব্দুর রাজ্জাক ও বিএনপি নেতা মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের থানা ও ওয়ার্ড থেকে ৩৬ জনকে আটক করা হয়েছে।
এ ছাড়া শাহবাগ, রমনা, পল্টন, নিউমার্কেট থানাসহ থানায় থানায় অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালালে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের ২০ জন নেতাকর্মী আহত হন বলে জানান দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইদুর রহমান মিন্টু। তিনি জানান, মতিঝিল থানাধীন ৯নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক সালু, ২১ নং ওয়ার্ডে পিজি হাসপাতাল ইউনিট নেতা আমিনুল ইসলাম, ৭নং ওয়ার্ড যুবদল নেতা ইমদাদুল ইসলাম অপু, ২১ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মো. শিহাব, ৫৮নং ওয়ার্ড বিএনপি’র ৬নং ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন মন্জু, শ্যামপুর থানাধীন ৪৭ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র মো. সোহেল এবং আব্দুর রাজ্জাক, মনির হোসেন, খিলগাঁও থানাধীন ৭৫নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সহ-সভাপতি মো. বাদল মোল্লা, বৃহত্তর সবুজবাগ থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র অন্যতম নেতা খন্দকার ওসমান গনি খান টুটুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুই মহানগর থেকে প্রায় ৭০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৭ দিনে সারা দেশে ৪২৮৩ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলা হয়েছে ৮০টি।
স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে অবরোধের প্রথম দিনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের সময় পুলিশের টিয়ার শেলে আহত হওয়া আশিক মিয়া (৫৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিটে বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। নিহত মো. আশিক মিয়া একজন চা দোকানি। তিনি ভৈরব পৌরশহরের গাছতলাঘাট এলাকার মৃত কাদির মিয়ার ছেলে। তবে বিএনপির দাবি, মো. আশিক মিয়া ভৈরব পৌর বিএনপি’র ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য।
এদিকে নিহত আশিক মিয়া ভৈরব পৌর বিএনপি’র ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য বলে দাবি করেছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সভাপতি মো. শরীফুল আলম। তিনি বলেন, কুলিয়ারচরে বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি করে আমাদের দুইজন নেতাকে হত্যা করেছে। একইভাবে ভৈরবেও পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর নগ্ন হামলা চালায় এবং গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। টিয়ার গ্যাসে গুরুতর আহত হয়ে আমাদের ভৈরব পৌর বিএনপি’র ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য আশিক মিয়া মারা গেছেন। এ ব্যাপারে ভৈরব সার্কেলের এএসপি দেলোয়ার হোসেন জানান, টিয়ার গ্যাসে মৃত্যুর বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে যদি এমন কোনো ঘটনা হয়ে থাকে, তা ডাক্তারের দেয়া রিপোর্টে জানা যাবে।
আব্বাস ও আলাল ৫ দিনের রিমান্ডে
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শুনানি শেষে এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গতকাল বিকাল ৩টার দিকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালতে তোলা হয় মির্জা আব্বাসকে। আদালতে তোলার সময় মির্জা আব্বাস স্লোগান দেয়া নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিজয়ের চিহ্ন দেখান। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অন্যদিকে তার আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ৫ দিনের রিমান্ডই মঞ্জুর করেন। শুনানি চলাকালে মির্জা আব্বাস কথা বলতে চান। এ সময় বিচারকের অনুমতিক্রমে তিনি বলেন, আমাদেরকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। এক সময় দেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে। আমি ভবিষ্যদ্বাণী বলে দিলাম।
তিনি বলেন, আমি কিছু কথা বলতে চাই। কখনোই কথা বলি না। আমার কোনো কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মানুষ জানতে চায় কী হয়েছিল সেখানে। তিনি উত্তরে বললেন, সেখানে আমার সাইডে লোহা দেখতে পাই। তিনি আরও বলেন, আমি ৫০ বছর ধরে রাজনীতি করি। বহু মিছিল করেছি। আন্দোলন করে এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছি। এত বছরে এমন কোনো মামলা হয়েছে কিনা তা দেখিনি।
এদিকে গতকাল বিকালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়। অন্যদিকে তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফিউদ্দিন তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।