খামার মালিক কারাগারে, খাবার না পেয়ে মরছে গরু
পুলিশের হাতে মাসুদ রানা আটক হওয়ার পর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার ওই আদর্শ খামারে দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। ১৬ জন শ্রমিক কাজ করলেও মালিক না থাকায় বেতন না পেয়ে খামার ছেড়ে চলে গেছেন তারা।
প্রথম নিউজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ: হলস্ট্রিন ফ্রিজিয়ান জাতের বিশালদেহী গাভী। কিন্তু খামারে থাকা বেশিরভাগ গরু ও বাছুরের চোখের কোণে গড়িয়ে পড়ছে পানি। দেখে মনে হচ্ছে, সবগুলো গরু কোনো বিশেষ রোগে আক্রান্ত। খামারে মানুষ প্রবেশ করা মাত্রই হাম্বা হাম্বা শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। গরুগুলোর পেটের পাশ দিয়ে সুস্পষ্ট দেখা মিলছে হাড়ের। উন্নত জাতের এসব গরুর এমন বৈশিষ্ট্য দেখে যে কেউই অবাক ও হতাশ হবেন। খামারের মালিক না থাকায় প্রয়োজনীয় খাবার ও যত্ন না পেয়ে এমন দুরাবস্থা গরুগুলোর। শুধুমাত্র খাবার ও যত্ন না পেয়ে গত কয়েক মাসে মারা গেছে পাঁচটি গরু।
এমন দুরাবস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের মধুমতি ডেইরি খামারের। খামারের মালিক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনিবন্ধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা একটি অস্ত্র মামলায় কারাগারে রয়েছেন। পুলিশের হাতে মাসুদ রানা আটক হওয়ার পর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার ওই আদর্শ খামারে দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। ১৬ জন শ্রমিক কাজ করলেও মালিক না থাকায় বেতন না পেয়ে খামার ছেড়ে চলে গেছেন তারা।
অর্ধশতাধিক উন্নত জাতের গরুর এই খামারে বর্তমানে তিনজন কাজ করলেও দীর্ঘ ৫ মাস ধরে তারাও বেতন পাননি। ঠিক মতো খাবার ও যত্ন না পেয়ে ইতোমধ্যে পাঁচটি উন্নত জাতের গাভী মারা গেছে। খামারের পাশেই মৃত গরুগুলো কবর দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যেগুলো বিক্রি করা হয়েছে পানির দামে। দৈনিক ১০ মণ দুধ সরবরাহ করা খামারটি থেকে এখন দৈনিক দুধ পাওয়া যায় এক মণেরও কম।
অন্যদিকে, পাওনা টাকার দাবিতে মাসুদ রানার বাড়ির সামনে প্রতিদিন শতশত মানুষ জমায়েত হচ্ছেন। জানা যায়, মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার জেলাজুড়ে প্রায় ৪০টির অধিক শাখায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের প্রায় ১০৫ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। এসব টাকায় ট্রাকের ব্যবসা, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতসহ খামার স্থাপন করেন মাসুদ রানা। কিন্তু তিনি কারাগারে যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় মধুমতির বেশিরভাগ শাখা। ফলে আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে হাহাকার তৈরি হয়েছে পাওনাদারদের মনে। দফায় দফায় আদালতে মামলা, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, সমাবেশ, প্রশাসনের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেও মেলেনি কোনো সুরাহা।
গ্রাহকদের দাবি, এক লাখ টাকায় মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। মাসুদ রানা থাকা পর্যন্ত কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ করেই অস্ত্রসহ আটকের পর সবকিছু থমকে যায়। একদিকে, খামারে মরছে গরু, অন্যদিকে টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন গ্রাহকরা। মধুমতি ডেইরী খামারের শ্রমিক আব্দুল বারী বলেন, মালিক আটকের পর বেতনের টাকা না পেয়ে ১৬ জন শ্রমিকের সবাই চলে গেছে। আমরা মাত্র তিনজন রয়েছি এখানে। গরুগুলোর অবস্থা দেখে ছেড়ে যেতে পারিনি। এখন খামার দেখভাল করার কেউ নেই। খাবার দিতে পারছি না এসব গরুকে। এমনকি খাবার না পেয়ে পাঁচটি গরু মারা গেছে। গরুর গোবর বিক্রি করে যা পাই, তা দিয়েই কোনক্রমে গরুগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
খামারে থাকা পাঁচটি গরুকে নিজ হাতে মাটি দিয়েছেন খামারের শ্রমিক আশিক আলী। তিনি বলেন, যে গরু নিজ হাতে খাবার দিয়ে যত্ন করে বড় করেছি, সেই গরুকে খাবারের অভাবে মরতে দেখার কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না। শুধু গরু নয়, গাড়লগুলোও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। যেসব গরু-গাড়লকে দৈনিক ১২ রকমের দানাদার খাবার দিতাম, এখন তার কিছুই পারি না। গরুর চোখের পানি দেখে নিজের চোখের পানিও বের হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মধুমতি ডেইরী খামার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্যে একটি আদর্শ খামার। এই খামার থেকে অনেকেই বাছুর ও বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে গিয়ে কাজে লাগিয়ে খামার তৈরি করেছেন। কিন্তু এর মালিক মাসুদ রানা পুলিশের হাতে আটকের পর থেকে খামারের সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। এখন গরু ও গাড়লগুলোর খাবার সংস্থান হচ্ছে না। কয়েকটি গরু মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। খামারের পাশেই বাড়ি সাজেদা বেগমের। তিনি বলেন, খামার চালুর শুরু থেকেই এটি দেখছি। খুব কম সময়েই খামারটি অনেক বেশি পরিমাণে দুধ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এখন খামারের বেহাল দশা। মালিক কারাগারে, তাই খামারের এমন বেহাল দশা।
খামারের স্থবিরতা মতোই অবস্থা মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের। দিনমজুর স্বামীর জমানো প্রায় ১ লাখ টাকা রেখেছিলেন উজালা বেগম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মাসুদ রানা আটকের পর থেকে এনজিওর শাখা বন্ধ রয়েছে। তালাবদ্ধ অফিসে মাঝেমধ্যে মাঠকর্মীদের পাওয়া গেলেও টাকা ফেরত দিতে চায় না। এখন টাকা দিতে না পেরে স্বামী আমাকে প্রতিদিন মারধর করে। বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায়।
স্ত্রীর ক্যানসার হলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না সাদিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, জমি বিক্রির সাড়ে ৩ লাখ টাকা মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় রেখেছিলাম। টাকা নেওয়ার সময় তারা কথা দিয়েছিল, যখন ইচ্ছে টাকা উঠাতে পারব। কিন্তু মাসুদ রানা আটক হওয়ার পর সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি প্রধান কার্যালয়ও বন্ধ রয়েছে। টাকার অভাবে মৃত্যুশয্যায় স্ত্রী অথচ চিকিৎসা করাতে পারছি না।
শিবনারায়ণপুর গ্রামের সুলেখা বেগম জানান, আমরা জানি মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এমডি মাসুদ রানা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল আরও অনেকেই ছিলেন। যেকোনো কারণে মাসুদ কারাগারে রয়েছে্ তার মানে কি, সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে? এটা কোনো কথা? জনগণের কোটি কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আমরা চাই, প্রশাসন জনগণের টাকা ফেরত দিতে উদ্যোগ নিবে।
গরু ও জমি বিক্রি করে আরেক জায়গায় জমি কিনতে চেয়েছিলেন মারিজা খাতুন। নতুন জায়গায় জমি কেনার জন্য ২ লাখ টাকা বায়না দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কথা ছিল জমি রেজিস্ট্রির সময় টাকা ফেরত দিবে। কিন্তু এর আগেই মাসুদ রানা আটক হওয়ায় টাকার কোনো হদিস পাচ্ছি না। জমি কেনার জন্য যেই ২ লাখ টাকা দিয়েছিলাম তাও আর ফেরত পাব না।
মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার বিনোদপুর শাখার ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা জনগণের টাকা জামানত নেওয়ার পর তা মাসুদ রানার ইচ্ছাতেই অফিসে জমা রাখতাম। এরপর এসব টাকা দিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি আটকের পর গ্রাহকেরা আমাদের উপর ব্যাপক চাপ দিচ্ছেন টাকা ফেরত নিতে। কিন্তু আমরা কোথা থেকে টাকা দেব। তাই উপায় না পেয়ে শাখা অফিসের কার্যক্রম বিভিন্ন স্থানে বন্ধ রাখা হয়েছে। মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এরিয়া ম্যানেজার তানভীর আলী বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা আটকের পর তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা খাতুনের উচিত ছিল সকল দায়িত্ব নেওয়ার। কিন্তু মাসুদ রানা আটকের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। আমরা এখন অপেক্ষায় রয়েছি, মাসুদ রানা ফিরে আসার। এরপর গ্রাহকের টাকা ফেরত কীভাবে দিবেন তিনিই জানেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ বলেন, মধুমতির প্রতারণার বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি যেহেতু প্রতারণার, তাছাড়া আদালতে মামলা চলছে। এ নিয়ে পুলিশের তেমন কিছু করার নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার আগে অবশ্যই আগে খোঁজ-খবর নিতে হবে। এ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়া মধুমতির বিষয়ে আদালতে কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। আদালত নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর গোমস্তাপুরে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানাকে একটি অবৈধ অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশ। গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ব্রীজের টোলঘর সংলগ্ন উদয় নগর এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার দেহ তল্লাশি করে একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, ৪ রাউন্ড গুলি ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ। মাসুদ রানা শিবগঞ্জ উপজেলার শিবনারায়নপুর গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে।