ঋণ ও করখেলাপিদের ছাড় নয়

সাম্প্রতিক সময়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

ঋণ ও করখেলাপিদের ছাড় নয়
ঋণ ও করখেলাপিদের ছাড় নয়

প্রথম নিউজ, ঢাকা: সাম্প্রতিক সময়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে বহির্খাতের চাপ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ২২ বিলিয়ন ডলার। জুন পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো বছরে যা ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এটি অর্থনীতির জন্য বিশাল চাপ। এ অবস্থার অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ খেলাপি ও কর ফাঁকিবাজদের ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ব্রিফিংয়ে মঙ্গলবার এসব কথা বলা হয়।

সিপিডির কার্যালয়ে এ ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। এ সময়ে বক্তারা বলেন, এবারের বাজেটে মূল ফোকাস হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো। বিশেষ পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের কাছে আয়ের পুনর্বণ্টন জরুরি। এছাড়াও ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয় সীমা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। তাদের মতে, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে এখনই বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় রয়েছে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটি রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের সময়ে জনগণের ওপর নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে স্বল্প সংখ্যক কর খেলাপি ও ঋণখেলাপি অসন্তুষ্ট হবে, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। বরং তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান নেওয়া হলে জনগণ খুশি হবে। আর এই বিষয়টি অত্যন্ত সহজে যে কেউ বুঝবে। তিনি বলেন, বাজেটে কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। ফলে ঋণ ও কর খেলাপিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের পথ নকশা আমরা এবারের বাজেটে প্রত্যাশা করছি। আর এটিই নির্বাচনের আগে সরকারের জন্য বড় পদক্ষেপ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সেক্ষেত্রে উলটো দেখছি। কর খেলাপিদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধে অর্থ জমা দেওয়ার সময় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি বাজারে বিপরীতমুখী বার্তা দিচ্ছে। তারমতে, কর খেলাপিদের ধরার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত শ্রীলংকার বিষয়টি সামনে এসেছে। দেশটির মানুষ অনেক বেশি শিক্ষিত। তাদের অর্থনীতিতেও অনেক শক্তির জায়গা ছিল। কিন্তু কিছু ভুল সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, শ্রীলংকা কখনোই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় (এলডিসি) ছিল না। ১৯৭১ সালে ২৫টি দেশ নিয়ে এলডিসি ক্যাটাগরি করা হয়, সেখানে শ্রীলংকার নাম আসেনি। তবে অর্থনৈতিকভাবে খারাপ হওয়ার পর এবার এলডিসিতে আসতে পারে। তিনি বলেন, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো দেশটি ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রজেক্ট করেছে। আবার প্রজেক্টের সময় বাড়িয়েছে। এতে ব্যয়ও বেড়েছে। এ অবস্থায় প্রজেক্ট শেষ না হলেও ঋণ পরিশোধের সময় চলে এসেছে। যা দেশটির বিপদের কারণ। তিনি বলেন, এখান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার আছে। আমাদের বড় বড় প্রকল্পগুলো যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয়, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানো উচিত নয়।

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের সামনে ৪টি মাইল ফলক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ, ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়ন, ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া। এক্ষেত্রে নীরবে আমাদের কাছ থেকে সময় চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শুধু সামষ্টিক অর্থনীতি দিয়ে এই লক্ষ্য পূরণ করা যাবে না। এর সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নতুন অর্ডার প্রয়োজন। টেকসই প্রবৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশের উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু এই অর্ডারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মধ্যমেয়াদি যে ধরনের পদক্ষেপ দরকার, সেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির জন্য আমরা ৮টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছি। এগুলো হলো-ঋণ ও দায় ব্যবস্থাপনা, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, সরকারি ব্যয়ের সুশাসন, খাতভিত্তিক সুশাসন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, রাজস্ব কাঠামো তৈরি এবং কর আদায়ের ব্যবস্থাপনা। সরকারের বাজেটে কাঠামোতে দ্রুত এগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আজকের ব্রিফিংয়ে এগুলোই আলোচনায় উঠে এসেছে। খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ঋণখেলাপি ও কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে আমরা মনে করি, নির্বাচনের কারণে এদের উৎসাহিত করা উচিত নয়। তিনি বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলেও ইলেকশনের বছরে সরকার এসব সংস্কার করতে চায় না। এরপরও বাজেট বক্তৃতায় এদের ব্যাপারে আমরা সরকারের নীতিগত অবস্থান শুনতে চাই।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এবারের বাজেটে আমাদের রাজস্ব আয়ের কাঠামোতে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে করোনার পর এ বছরের বাজেটে অগ্রাধিকারে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। এক্ষেত্রে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের মানুষের করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ টাকা। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে ৩ লাখ টাকার পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের জন্য, কর ৫ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত, ৫ শতাংশ করা উচিত। অন্যদিকে করোনার বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে সর্বোচ্চ কর হার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। আগামী বাজেটে তা আগের জায়গায় অর্থাৎ ৩০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও করোনার কারণে বেশ কিছু খাতে করপোরেট কর কমানো হয়েছিল। এগুলো আবার আগের জায়গায় নেওয়া উচিত। অন্যদিকে সিগারেট কোম্পানির করপোরেট কর ৫০ শতাংশ করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বৈদেশিক ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর ফাঁকি রোধে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর চাপ ও তদবির থাকবে। তার মতে, সংস্কারের একটি অংশ হলো প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়লে রাজনৈতিক চাপেও অনেক কিছু করা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, ভতুর্কি উৎসাহিত করা উচিত নয়। কারণ ভতুর্কি রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয়। কিন্তু আমাদের মতো দরিদ্র জনগণের কথা মাথায় রেখে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের জন্য কিছু কিছু খাতে ভতুর্কি দেওয়া যেতে পারে। তবে আগামীতে ক্রমান্বয়ে কীভাবে ভতুর্কি তুলে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টা করতে হবে। তবে ভর্তুকি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যার প্রয়োজন রয়েছে, ভর্তুকির সুবিধা তার কাছেই যেতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, জিনিষপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সরকারি তথ্যে প্রকৃত চিত্র আসছে না। ফলে ভুল তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ওই সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। এছাড়াও মুদ্রার বিনিময় স্থিতিশীল রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বাড়াতেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ জরুরি। না হলে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হবে। ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছর পর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক জোনের আওতায় দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ যথেষ্ট নয়, বলে মনে করেন তিনি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও ভর্তুকিতে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তার যে তথ্য দেওয়া হয়, তারমধ্যে ২৫ শতাংশই সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনে ধরা হয়। এই পেনশনের অংশ বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ একেবারেই কম। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে সিপিডি প্রস্তাব করছে, এ খাতে ন্যূনতম ভাতা ১ হাজার করা এবং ২০ লাখ মানুষকে এই সেবার আওতায় নিতে হবে। এছাড়াও মূলধন ঘাটতি কমানো এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom