আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ বাসায় গিয়ে নেওয়া হয়
নতুন পাসপোর্টের আবেদন শিরীনের
প্রথম নিউজ, অনলাইন:
- হত্যা মামলার আসামি পলাতক এই সাবেক স্পিকারকে খুঁজছে পুলিশ
- আবেদন দেওয়া বাসার ঠিকানায় থাকেন না ১০ মাস
- একই সুবিধায় পাসপোর্ট করছেন স্বামী ইশতিয়াক হোসাইন
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের (এমপি) লাল পাসপোর্ট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। যারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও জাতীয় সংসদের পদত্যাগী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর লাল পাসপোর্টও বাতিল হয়েছে। রংপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিন (৩৮) নিহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলার আসামি তিনি। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থাকা সাবেক এ স্পিকার গত ৩ অক্টোবর তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইনসহ ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ ই-পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন। গত ১০ অক্টোবর তাদের আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের ছবি দেওয়ার তারিখ ছিল, যা তারা ঘরে বসেই দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অথচ ই-পাসপোর্ট আবেদনের নিয়মাবলিতে বলা আছে, সবকিছু ঘরে বসে করতে পারলেও নির্ধারিত তারিখে আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিতে আবেদনকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। শুধু অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা পাসপোর্ট অফিসের বিশেষ সেবা মোবাইল টিমের মাধ্যমে ঘরে বসে বা হাসপাতালে থেকে এ সুবিধা নিতে পারবেন। যদিও আবেদন করার পর আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলেও, গতকাল সোমবার পর্যন্ত শিরীন দম্পতির পাসপোর্ট প্রস্তুত হয়নি বলে জানা গেছে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, সাবেক এ স্পিকার ও তার স্বামী অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের বাগে নিয়ে অনৈতিকভাবে ভিআইপি সুবিধা নিচ্ছেন। এজন্য খরচ করেছেন মোটা অঙ্কের টাকা। তা না হলে, হত্যা মামলায় আত্মগোপনে থাকা এ আসামি কীভাবে ঘরে বসে পাসপোর্ট করতে পারেন, সে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? শিরীন শারমিন চৌধুরীর পাসপোর্টের আবেদন করার বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ পাসপোর্ট অর্ডার, ১৯৭৩-এ এই অধিকার দেওয়া আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আসলে কিছু করার নেই।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য গতকাল পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুর মোবাইল ফোনে কল করা করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। শিরীন শারমিন ও তার স্বামী ইশতিয়াক হোসাইনের পাসপোর্টের আবেদনে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর ধানমণ্ডির ১৬ নম্বর সড়কের একটি বাসার ৪-ই ফ্ল্যাট। গত রবিবার সেই বাসায় গিয়ে দুজনের একজনকেও পাওয়া যায়নি। কথা হয় বাসাটির রক্ষণাবেক্ষণকারী মো. শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ বাসার দায়িত্বে থাকা শাহাবুদ্দীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এ বাসায় কাজ শুরুর পর থেকে তাদের (শিরীন শারমিন ও সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন) এখানে এক দিনও আসতে দেখিনি। তারা এখানে থাকেন না। মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে এই বাড়ির মালিক সাবেক স্পিকার হলেও তিনি ও তার পরিবারের কাউকেই এ কদিন এখানে আসতে দেখিনি। তারা কোথায় আছেন, এটাও জানি না।’
অক্টোবরের ৩-১০ তারিখের মধ্যে পাসপোর্ট অফিস থেকে কোনো লোকজন বাসাটিতে এসেছিল কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহাবুদ্দীন বলেন, ‘না, এমন কেউ আসেননি। পাসপোর্টের আবেদন ও তারা প্রকৃতই অসুস্থ কি না? এসব প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে কল করা হয় শিরীন শারমিন চৌধুরীর আবেদনে উল্লেখ করা মোবাইল ফোন নম্বরে। নম্বরটি খোলা থাকলেও কল রিসিভ করেননি কেউ। একইভাবে তার স্বামী ইশতিয়াক হোসাইনের আবেদনে উল্লেখ করা মোবাইল ফোন নম্বরে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এমন সুবিধায় (বাসায় বসে) শিরীন শারমিন চৌধুরী পাসপোর্ট করতে পারেন কি না? এমন প্রশ্ন করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. ফিরোজ সরকারের কাছে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শারীরিকভাবে অক্ষম ও ঘরের বাইরে বের হলে তার প্রাণ যাওয়ার হুমকি আছে এরকম কিছু বিষয় ছাড়া কেউই ঘরে বসে পাসপোর্টের জন্য আঙুলের ছাপ দিতে পারে না। এতে আইনের ব্যত্যয় হয়, আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি।’
সাবেক এ স্পিকার ও তার স্বামীর পাসপোর্টের আবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি কোনো বিশেষ শক্তি বা গোষ্ঠী সুবিধা নিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পাসপোর্ট পেতে তাদের সহায়তা করছে? বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিরীন শারমিন চৌধুরী সাবেক স্বৈরাচারের আমলের স্পিকার এবং হত্যা মামলার আসামি। পাসপোর্ট পাওয়া তার নাগরিক অধিকার হলেও বর্তমানে দেশে একটা বিশেষ অবস্থা চলছে। এ সময়ে তাদের পাসপোর্ট করতে দেওয়াটা সন্দেহজনক। তিনি তো বিদেশেও চলে যেতে পারেন। এভাবে তিনিসহ আরও যারা ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি, তারা পালালে বিচার হবে কীভাবে? সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, যাদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে এবং ছাত্র-জনতা হত্যার সঙ্গে যুক্ত, তাদের পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত একটি নির্দেশনা দেওয়া হোক।’