বাস-ট্রেনে চাপ, শেষ মুহূর্তে
সড়কে বেড়েছে গণপরিবহন ও যাত্রীর চাপ। ভিড় বেড়েছে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাটে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। ঢাকা ছাড়ছেন ঘরমুখো মানুষ। সড়কে বেড়েছে গণপরিবহন ও যাত্রীর চাপ। ভিড় বেড়েছে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাটে। প্রতি বছরের মতো যোগ হয়েছে ভোগান্তি। তার উপরে বাড়তি ভাড়ার চাপ। গতকাল দুপুর থেকেই যাত্রীর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। বিকাল নাগাদ রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো ও সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে উপচে পড়া ভিড় ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় এ বছর সবচেয়ে বেশি মানুষ ঈদের আনন্দ প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে গ্রামে যাচ্ছেন। এদিকে ভোগান্তি আর জনদুর্ভোগ নিয়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করছেন মানুষ। অনেকে গণপরিবহন সংকটে পড়ে বিভিন্ন উপায়ে পাড়ি জমাচ্ছেন। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা যায়, গণপরিবহনের পাশাপাশি, মোটরসাইকেল, পিক-আপ ভ্যান, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করছেন। ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনেও কমলাপুর রেল স্টেশনে ভোগান্তিতে পড়েছেন ট্রেনের যাত্রীরা। ভোর থেকেই নির্ধারিত ট্রেনের যাতায়াত করার জন্য যাত্রীরা কমলাপুর স্টেশনে আসলেও নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে যায়নি। এতে হাজার হাজার যাত্রী বিপাকে পড়েন। তীব্র গরম আর যাত্রী চাপে অনেকেই দুর্ভোগের শিকার হন। গতকাল সকালে কমলাপুর স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের স্রোত দেখা যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন মানুষ। সড়কপথের দুর্ভোগ এড়াতে গত কয়েকদিন ধরে কমলাপুর স্টেশনে দিনরাত অপেক্ষা করে টিকিট কেটেছেন তারা। সেই টিকিট দেখিয়েই স্টেশনের প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। নির্দিষ্ট ট্রেনে আগেভাগে উঠতে পেরে কেউ কেউ পেয়েছেন স্বস্তি। আবার অতিরিক্ত মানুষের চাপে ট্রেনের সিটে বসা নিয়ে কেউ পড়েছেন ভোগান্তিতে। ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে গেলেও কয়েকটি ছেড়েছে বিলম্বে। উত্তরবঙ্গগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটির সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি ছেড়েছে সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে। এতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
সকাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলো ঈদের যাত্রী নিয়ে সদরঘাট টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। তবে দুপুরের পর সড়রঘাটে যাত্রী চাপ বাড়তে থাকে। সদরঘাটের টার্মিনালে অবস্থান করা প্রতিটি লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে যাত্রী বেড়েছে কয়েকগুণ। লঞ্চের নিচতলার ডেক থেকে কেবিন ও অলিগলি সবখানেই ছিল যাত্রী। যাত্রীরা বলেন, গতকাল অফিস শেষে শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। তাই অফিস শেষে সদরঘাটে যাত্রীরা ভিড় করেছেন। এদিকে লঞ্চের টিকিট বিক্রির সরকারি নির্দেশনা মানছে না মালিকরা। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই মিলছে টিকিট। কাউন্টারে পর্যাপ্ত টিকিট না থাকলেও কালোবাজারে টিকিট বিক্রি হচ্ছে অবাধে অধিক মূল্যে। ঈদ উপলক্ষে স্পেশাল সার্ভিসের লঞ্চগুলোর রাখা হয়নি নির্দিষ্ট শিডিউল। এছাড়া ঈদযাত্রায় অনেক লঞ্চের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। ঢাকা থেকে বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীগামী প্রতিটি লঞ্চে ডেকের পাশাপাশি কেবিনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ডেকে লঞ্চ ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা ও কেবিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এমনটাই অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। লঞ্চের স্টাফরা জানান, গতকাল থেকে যাত্রী চাপ বেড়েছে। এবার সবচেয়ে বেশি মানুষ যাতায়াত করবে। এরইমধ্যে বিভিন্ন রুটে ঈদের স্পেশাল সার্ভিস চালু হয়েছে। এছাড়া নতুন কয়েকটি লঞ্চ যাত্রা করেছে। তবে যাত্রীরা যে যেভাবে পারছেন, তরিঘড়ি করে লঞ্চে উঠে যাচ্ছেন। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী উঠছে। আগামী কয়েকদিনে আরও বেশি যাত্রী উঠবে। সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে। তবে সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সদরঘাটে যাত্রীচাপ বাড়ছে। টার্মিনালে ভিড় করছেন অনেকে। যাত্রী নিয়ে লঞ্চ স্টাফরা টানাটানি করছেন। লঞ্চে যাত্রী দাঁড়ানোর মতো জায়গা না থকেলেও অনেক লঞ্চ টার্মিনালে ঘাটকরে যাত্রী তুলছেন। প্রশাসনের লোকজন লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তা মানছেন না।
এদিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী ও গাবতলী টার্মিনাল ঘুরে যাত্রীর বাড়তি চাপ দেখা গেছে। ফলে কাউন্টারে থাকা কর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করছে। কাউন্টার ম্যানেজাররা জানান, গত কয়েকদিন যাত্রীর চাপ স্বাভাবিক থাকলেও বিকাল থেকে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ইফতারির পর সেটা আরও তীব্র হয়। আগামীকাল থেকে যাত্রী সংখ্যা আরও বাড়বে। এদিকে টিকিট না পেয়ে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যাচ্ছে অনেকে। শ্যমলী কাউন্টার ম্যানেজার বলেন, বিকাল থেকে যাত্রীদের চাপ অনেক বেড়েছে। অফিস শেষ করে সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। টিকিট বিক্রির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আজকের টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেককে টিকিট দিতে পারিনি। তিনি বলেন, আজ থেকে যাত্রীদের ভিড় আরও বাড়বে। আবু সাঈদ নামের এক যাত্রী জানান, অফিস শেষ করে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। আগে থেকে টিকিট কাটা ছিল না। ভাবছিলাম আজ তেমন ভিড় হবে না। কিন্তু এসে দেখি অনেক ভিড়। সব টিকিট শেষ হয়ে গেছে। এজন্য ভেঙে ভেঙে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরেক যাত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, পরিবারের সবাইকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার টিকিট কাটা ছিল না। টার্মিনালে এসে টিকিট পেয়েছি। সড়কে অনেক যানজট হবে। কষ্ট করেই যেতে হবে।
অন্যদিকে গত কয়েক দিনের তুলনায় চাপ বেড়েছে মহাখালী বাস টার্মিনালেও। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ফেরা মানুষেরা ভিড় করছেন এই টার্মিনালে। এনা ট্রান্সপোর্ট বাস কাউন্টারের ম্যানেজার বলেন, বিপুল পরিমাণের মানুষ ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। অন্যবারের তুলনায় এবার অনেক আগেই টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে বাড়তি চাপ শুরু হয়েছে। শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা আনোয়ার হোসেন জানান, প্রতিবারের তুলনায় এবার চাপ বেশি। যাত্রীর চাপ শুরু হয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে তীব্র চাপ থাকবে। মহাখালী টার্মিনালে টিকিট নিতে আসা যাত্রীরা বলেন, কোনো বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, জামালপুরগামী কোনো বাসে টিকিট নেই। কুড়িগ্রামে যেতে মহাখালী টার্মিনালে বাসের জন্য অপেক্ষা করা শিক্ষার্থী কাওসার বলেন, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবো। ট্রেনের টিকিট পায়নি। এজন্য বাসের অপেক্ষা করছি। যাতায়াতে যতো কষ্টই হোক না কেন সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ঈদ করার একটা আনন্দ থাকে।
এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও দেশের উত্তর, পঞ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রধান সড়কে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। এতে বিভিন্ন স্থানে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। ঘণ্টারপর ঘণ্টা দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়েছেন ঘরমুখো মানুষ। সড়কের ভোগান্তি, দুর্ভোগ এড়াতে অনেকই ভেঙে ভেঙে বাড়ি ফিরছেন। যাত্রীরা বলছে, দূরপাল্লার বাসে করে বাড়ি যেতে হলে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে ভেঙে ভেঙে গেলে ৭ ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় পৌঁছানো যায়। ঝিনাইদহের আবুল হোসেন। গতকাল বন্ধুদের সঙ্গে যাত্রাপথে ভেঙে ভেঙে বাড়ি যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ঈদের সময় ঘাটে অনেক যানজট থাকে। প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘাটে বসে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভেঙে ভেঙে বাড়ি যাবো। বন্ধুরা মিলে যাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। গল্প করতে করতে চলে যাবো। মেহেরপুরের আরেক যাত্রী বলেন, ভেঙে ভেঙে বাড়ি গেলে অনেক কম সময় লাগে। লংরুটের বাসগুলোতে বাড়ি পৌঁছাতে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অন্যদিকে ভেঙে ভেঙে গেলে সাড়ে ৭ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। এজন্যই এভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews