সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা

সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। প্রতিপক্ষ আইনজীবীদের ওপর পুলিশের হামলা, সাংবাদিকদের মারধর। রাতে ভোট দেয়ার অভিযোগ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন। আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের সাদা প্যানেলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে হওয়া নির্বাচন একতরফাভাবে হয়েছে। এতে ভোট দেননি বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নীল প্যানেলের কেউ। ভোটে ছিল না কোনো উৎসবের আমেজ। উদ্বেগ, শঙ্কা আর পাল্টাপাল্টির মধ্যে কেটেছে ভোটের দুইদিন। তাই ভোটগ্রহণ শেষে ফল নিয়েও ছিল না কারও কোনো আগ্রহ। নির্বাচনকে ঘিরে হয়ে যাওয়া সংঘাতের পর নিন্দার ঝড় বইছে সর্বত্র।

সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা
শেষ হলো সুপ্রিম কোর্ট বারের নজিরবিহীন ‘একতরফা’ ভোটআওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশি ঝামেলার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনের নির্বাচন।

প্রথম  নিউজ, ঢাকা :সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। প্রতিপক্ষ আইনজীবীদের ওপর পুলিশের হামলা, সাংবাদিকদের মারধর। রাতে ভোট দেয়ার অভিযোগ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন। আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের সাদা প্যানেলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে হওয়া নির্বাচন একতরফাভাবে হয়েছে। এতে ভোট দেননি বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের  
নীল প্যানেলের কেউ। ভোটে ছিল না কোনো উৎসবের আমেজ। উদ্বেগ, শঙ্কা আর পাল্টাপাল্টির মধ্যে কেটেছে ভোটের দুইদিন। তাই ভোটগ্রহণ শেষে ফল নিয়েও ছিল না কারও কোনো আগ্রহ। নির্বাচনকে ঘিরে হয়ে যাওয়া সংঘাতের পর নিন্দার ঝড় বইছে সর্বত্র।দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা এবং একতরফা ভোটের ঘটনায় সাধারণ মানুষও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। 

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে গতকালও বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারী ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) পাঁচ শতাধিক পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মোতায়েন ছিল। আইনজ্ঞদের মতে- গত এক দশক আগেও সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতেন। বারের বাইরে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের ভিতরে ছিল সবাই সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, গত ৫/৭ বছর ধরে বারের নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। 

নির্বাচনের দ্বিতীয়দিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১০টা ২০ মিনিটে ভোটগ্রহণ  শুরু হয়। ১০টা ১৩ মিনিটে পুলিশের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ব্যালট পেপার নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢোকেন কমিশনের এক সদস্য। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান মনির  বলেন, ১০টা ২০ মিনিটে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বিকাল ৫টায় শেষ হয়। তবে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরেও ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। এ প্রতিবেদক ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে-যাওয়া যাবে না বলে বাধা দেন সাদা দলের কয়েকজন আইনজীবী। পরে কমিশনের এক সদস্যকে ফোন দিয়ে অনুমতি চাইলে তিনিও অনুমতি দেননি। 

নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা ভোট দিলেও অবৈধ ভোট ঘোষণা করে বিরত ছিলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের দাবি আগে নতুন নির্বাচন কমিশন পরে ভোট গ্রহণের তারিখের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।  কমিশন সূত্র জানায়, নির্বাচনে দুইদিনে মোট ৪১৩৭ ভোট কাস্ট হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা সাব কমিটির আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান মনির  বলেন, সবগুলো ব্যালট এনে বক্স এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে। গণনা শুরু করা হয়েছে। প্রথম দিনে ২২১৭ ভোট এবং আজ ১৯২০ ভোট কাস্টিং হয়েছে।

দুই দফা হাতাহাতি আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের
সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গতকাল ফের ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতিতে জড়ান আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এনেক্স ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের একতরফা ভোটগ্রহণ প্রতিহত করতে নির্বাচনী বুথের দিকে যেতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি ঘটনা ঘটে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ভোটকেন্দ্রে ঢোকার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেন। তবে প্রবেশপথে প্রতিহত করেন আওয়ামী লীগপন্থি আইনবীজীরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুইপক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করে। বিকাল ৪টার দিকে তারা  দুইপক্ষ ফের মুখোমুখি অবস্থান নেন। এতে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। বিএনপিপন্থি সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মাঝে ধস্তাধস্তি হাতাহাতি শুরু হয়। এতে কয়েকজন ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট সোনালী ব্যাংকের সামনে  আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের ‘ভোট চোর’ আখ্যায়িত করে সেøাগান শুরু করেন। এরপর আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরাও সন্ত্রাসীদের কলো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও সেøাগান  শুরু করেন। পাল্টাপাল্টি সেøাগানে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ। এ সময় প্রায় ৪০ মিনিট ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে। 

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে নালিশ

সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন পরিচালনাকে ঘিরে পুলিশের হামলাসহ বুধবার ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৮ সদস্যের আপিল বিভাগে তুলে ধরেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা ১১টার সময় খাস কামরায় আসেন। প্রয়োজন হলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে নেবো। সকাল ৯টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থি  আইনজীবীরা। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর ৭ বিচারপতি। এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, বুধবার আদালত প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা  ঘটেছে, যা আজও চলমান। আমাদের অনেকের রুমে তালা লাগানো আছে, অনেকের রুমের চারপাশে পুলিশ দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কিনা, তা দেখতে হবে। এই অঙ্গনে এটা কি অনুমোদিত? তারা সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। আমরা সুরক্ষা চাই। বিএনপি প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার  রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। সমিতির নির্বাচন হয় সব সময় উৎসবমুখর। তবে এবার কী হলো? আজও আমি রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগানো। কক্ষের সামনে পুলিশ রয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক আইনজীবী আহত হয়েছেন। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। গতকালের ঘটনা দেখেছেন, পুলিশ কীভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়েছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমি প্রার্থী, আমি কেন ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারবো না? বেশ কয়েকটি পত্রিকা আদালতে উপস্থাপন করে রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আপনারা এ অঙ্গনের অভিভাবক। আপনারা দেখেন। বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরীকে প্রধান করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয়। ১৩ই মার্চ সন্ধ্যায় প্রার্থী পরিচিতি সভায় তিনি দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু হঠাৎ কী হলো! তিনি পদত্যাগ করলেন। তিনি ফোনে আমাকে জানিয়েছেন, বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। তারা আলাদা ব্যালট পেপার তৈরি করে যেভাবে বলবে, সেভাবে কাজ করতে বলেছে। তাই উনি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পর এখন সর্বসম্মতিক্রমে নতুন পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে। তবে তা না করেই তারা ভোট গ্রহণ শুরু করেছে। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ঘায়েল করতে মামলা করা হয়েছে। 

রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, বুধবার  রাতে মো. মনিরুজ্জামান (নির্বাচন উপ-কমিটির আহ্বায়ক) সাহেব বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। আমাকে ও সভাপতি প্রার্থীসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আরেকটি মামলা করেছে সমিতির প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দিয়ে। সেখানে সমিতির বর্তমান কমিটির ৬ জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আপনাদের সবাইকে সম্মান করি। আপনারা ২ জন ১১টার সময় আসেন। কোনো করণীয় থাকলে করবো। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডেকে নেবো। সমিতির সভাপতি পদপ্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটকেন্দ্রে ৩০০ থেকে ৪০০ পুলিশ ঢুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সবাই পড়ে যাচ্ছিল আর পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়েছে। আমার পায়ে ব্যথা। আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। অনেক আইনজীবী ও সাংবাদিককে আহত করা হয়েছে। একপর্যায়ে রুমের তালা খুলে দেয়ার ও পুলিশ সরানোর আরজি জানান রুহুল কুদ্দুস। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, কোর্টে বসে এটি বললে আদেশ হয়ে যাবে। ১১টায় আসেন, শুনি।

প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল

 প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের ৭ বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার পর বেলা সোয়া একটার দিকে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি বেসরকারি সংগঠন। এখানে প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই। এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, প্রধান বিচারপতি তাকে ডেকেছিলেন। ওনার কক্ষে গিয়েছিলাম। তখন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বসে ছিলেন। ওনারা আমাকে জানান, বিএনপি থেকে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী কথা বলতে গিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি সমিতির বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। প্রধান বিচারপতির এখানে কিছু করার নেই। এটি আপনারা যারা এ বিষয়ে বিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সবাই মিলে পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করেন। যেহেতু এটি প্রাইভেট সংগঠন, সমিতির বিষয়। প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই। 

নির্বাচনে পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পুলিশ নিজের ইচ্ছায় আসেনি। বার থেকে চিঠি দিয়ে তাদের জানানো হয়েছিল। তাই তারা এসেছে। তবে সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ২০০৬ সালে পুলিশ বারের ভিতর ঢুকে আমাদের বেধড়ক পিটিয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই পেটানো হয়েছিল। বারের সামনে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছিল। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে কাকে দোষ দেবো? বিএনপিতো প্রথম থেকেই নির্বাচন করতে চাচ্ছিল না। ভোটের আগের রাতে তারা যে রুমে ব্যালট পেপার থাকে সেখানে  অনধিকার ঢুকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। প্রতিবাদ জানানোর একটা প্রক্রিয়া আছে। দরখাস্ত করা যায়। অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো যায়। কিন্তু তারা টেনে নিয়ে ব্যালট পেপার ছিঁড়েছে। এটা কেমন প্রতিবাদ। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতি বলেছেন নির্বাচনের বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। তবে তিনি ভোটের পরিবেশটা সুষ্ঠু রাখতে বলেছেন। এখানে আইনজীবীদের সমস্যা তাদেরই সমাধন করতে হবে। এটা আদালতের বিষয় না। এ বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তাই প্রধান বিচারপতি উভয়পক্ষকে এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন।

আমিন উদ্দিন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে হলে দু’পক্ষকেই সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু একপক্ষ যদি ব্যালট পেপার ছিঁড়ে নিয়ে যায়, তখন আরেকপক্ষ বাধা দিবে। এতে পরিবেশ ঠিক থাকবে না। বিএনপি’র নতুন নির্বাচনের দাবির প্রশ্নে তিনি বলেন, দাবি তারা করতেই পারেন। দাবি করার অধিকার তাদের আছে। তবে বার যদি মনে করেন। তাহলে তাদের দাবি বিবেচনা করতে পারেন। সেটা তাদের ইচ্ছা। তবে আমি আজ ভোটের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। শত শত লোক লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছে। বিভিন্ন জেলার আইনজীবীরা  লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছেন। 

ন্যক্কারজনক ঘটনা, ঐতিহ্য হারাচ্ছে বার

গত এক দশক আগেও সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতেন। বাইরে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের  ভেতরে ছিল সবাই সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেন, গত ৫/৭ বছর ধরে বারের নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। গত ২ টার্ম বারের ভোট  ঐতিহ্য শেষ করে দিতে একশ্রেণির সুবিধাভোগীরা উঠেপড়ে লেগেছে। এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের হট্টগোল ও পুলিশের হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে তারা মনে করেন।

সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশন আহ্বান জানিয়েছেন। কমিশন মনে করে, গণমাধ্যমকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে বিভিন্ন জায়গায় যাবেন এবং সংবাদ সংগ্রহ করবেন এটাই স্বাভাবিক। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের হামলা স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। যথাযথ তদন্ত করে হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় কমিশন।

গত ২ দিন যা ঘটেছে সে বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বেশ কয়েকবারের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘ব্লাস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাকালীন এই সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে। তিনি মানজমিনকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের একটা ঐতিহ্য ছিল। আইনজীবী পেশায় যে অর্জনটা ছিল, সেটা গত ২ দিনে আমরা বিসর্জন দিয়েছি। আমরা সবকিছু জলাঞ্জলি দিলাম। এই জলাঞ্জলিতে আইনজীবীরা না, আইনজীবীদের ভেতরে একটা স্বার্থান্বেষী মহল সহায়তা করেছে। সাধারণ আইনজীবীরাও এমন চান না। বরাবর আইনজীবীরাই রাজনীতি করেছেন। এখন আর আইনজীবীরা রাজনীতি করেন না। রাজনীতি চলে গেছে লুটেরাদের হাতে। উভয় দলেই একই অবস্থা। দল যারা করতেন, তারা বার এসোসিয়েশনের ক্ষেত্রে এসে একটি ঐক্যমতে থাকতেন। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখতেন না। আইনের শাসন, শাসনতন্ত্রকে তুলে ধরা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা আইনজীবীরাই বলতেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা আইনজীবীরাই বলতেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আইনজীবীদের শক্ত ও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এবার দেখলাম এর সবকিছুরই জলাঞ্জলি হয়ে গেছে। সামরিক শাসনের সময়ও দেখিনি যে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেছে। এটাই একমাত্র জায়গা ছিল, যেটা মানুষকে আশার আলো দেখাতো এবং যেখানে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ছিল। বরাবর এখানে নির্বাচনে স্বচ্ছতা ছিল। সেটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। কেবল প্রশ্নবিদ্ধ না, একেবারে মাটিচাপা দিয়ে দেয়া হলো। বলা যায়, কবর দিয়ে দেয়া হলো।

সাংবাদিকদের উপর পুলিশ আক্রমণ নিয়ে সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গত ২ দিন যা হয়েছে- তা সত্যিই ন্যক্কারজনক, বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা কখনো হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া পুলিশ ঢুকতে পারে না। এটা নিয়ে কোনো আইন নেই, তবে এমনটাই প্যাকট্রিস। প্রধান বিচারপতির পূর্বানুমতি ছাড়া কখনোই পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকতো না। তারা গেটে বা অন্যান্য জায়গায় থাকতো। আর বার এসোসিয়েশনের ভেতরে তো পুলিশকে কখনোই ঢুকতে দেখিনি, কখনোই না। বার এসোসিয়েশনের ইতিহাসে এই প্রথম এমন কিছু হলো। পুলিশ মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের পেটায়। এই ধারাটা কি অব্যাহতই থাকবে? আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে পুলিশকে ঠেকানোর কোনো পথ থাকবে না? এই যে বেধড়ক পেটানো বা অত্যাচার, এটা তো মূলত ব্যুরোক্রেটিক অ্যাটিচিউড। এর বিরুদ্ধে আমরা এখনো লড়াই করি। তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিক। যদিও কেউ নেয় না। 

একটি প্রবাদের কথা উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, কথায় আছে না অন্যর জন্য কুয়া খুড়লে, সেই কুয়ায় নিজেকেই পড়তে হয়। এটা প্রমাণিত। স্পেশাল পাওয়ার ১৯৭৪ করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগেছিল তারা। র‌্যাব গঠন করেছিল বিএনপি। সেই র‌্যাবের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ভুগেছে তারাই। এখন বিএনপি র‌্যাবের বিলুপ্তি চায়। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, যা ঘটার তা ঘটে গেছে। আমার মনে হয় না ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরে যাওয়াটা খুব সহজ হবে। কারণ, এরপর যদি বিএনপি কোনোদিন ক্ষমতায় আসে, তারাও এই ব্যবহারটা করবে। সেক্ষেত্রে তারা উদাহরণ দেবে, ওই সময়ে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট, আইনজীবী, বিচারপতি, প্রধান বিচারপতির ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের কোনো একটি বেঞ্চকে দিয়ে শুনানির ব্যবস্থা করতে পারতেন। হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুল ইস্যু করতে পারতেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের প্রত্যেক বিচারপতির এই এখতিয়ার আছে।  বার একটা বেসরকারি সংগঠন। প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই বলে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি বলবো তার করার আছে। বার সুপ্রিম কোর্টেরই প্রমিসেস। তারপরেও ধরলাম ওটা সুপ্রিম কোর্টের অংশ নয়। কিন্তু তিনি তো বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তিনি দেশের যেখানেই অন্যায় হবে, অনিয়ম হবে। তার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। মনে রাখতে হবে-এটা হয়েছে কোথায়? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে, সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নির্বাচনে। এখানে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে সারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে, সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নির্বাচনে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে সারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে? বুধবার সিনিয়র আইনজীবীদের সাক্ষাৎকার দেখলাম। তারা এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখে। আমার প্রশ্ন ২টা। প্রথমে, পুলিশ এলো কার কথায়? পিটালো কার কথায় বা কোন কারণে? এবং দ্বিতীয়, এটাকে কারা সমর্থন করছে? আমি একটা ভিডিওতে দেখেছি, এক পুলিশ একজন আইনজীবীর গালে চড় দিচ্ছে। শুনলাম, দেড়শ জনের বেশি আইনজীবী আহত হয়েছেন। তারা বাসায় চলে গেছেন। সাংবাদিকদেরও মারধর করার ভিডিও দেখলাম।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আইনজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি সংগঠন। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের বড় বড় আইনজীবী। তখন দলমত নির্বিশেষে সুপ্রিম কোর্ট বারের বিষয়ে সবাই এক ছিলেন। সে সময় বারের নেতাদের মধ্যে ভিন্ন মতালম্বীদের মধ্যেও সুসম্পর্ক ছিল। একে অপরকে সাংঘাতিক শ্রদ্ধা করতো। এখন একটু ভাটা পড়েছে। তাই বারের নেতাদের আগের ঐতিহ্যর কথা স্মরণ করে দু’পক্ষকেই সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ২ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট বারে অনৈক্য দেখছি। যেসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আইনজীবীদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আইনজীবীরা যদি গোলমাল, মারামারি করে তাহলে কী হয়। একটা স্থায়ী সমাধান করতে বর্তমানে যারা সিনিয়র আছেন তারা বসে এর সমাধান করার আহ্বান জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ঠিক হয়ে যাবে। একটু সচেষ্ট হলেই ফিরে আসবে বারের সেই ঐতিহ্য।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশে যে গণতন্ত্রের অভাব এর প্রতিফলন হলো সুপ্রিম কোর্টে সাম্প্রতিককালের নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্ট বারের গত ২ নির্বাচন দেখে মনে হচ্ছে, বারের নির্বাচনের জন্য ২-৩ সপ্তাহের জন্য একটা তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনী ব্যবস্থা দরকার। বিদ্যমান অবস্থায় আর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, বিগত দিনে বারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল বলে মনে হয় না। সবসময় সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচন হয়েছে। এখন দেশে গণতন্ত্রহীনতার প্রভাব বিরাজ করছে। সুপ্রিম কোর্টও সেই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এটা এখন স্পষ্ট।