রিজার্ভ চুরির ৯ বছর: যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ দেশ এখনও দেয়নি তথ্য

বিদেশি ৭৬, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা

রিজার্ভ চুরির ৯ বছর: যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ দেশ এখনও দেয়নি তথ্য

প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘবদ্ধ হ্যাকার গ্রুপ যে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সরিয়েছিল, তা পুরোপুরি উদ্ধারের কোনো কিনারা হয়নি। এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করার পর তদন্তে নামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ৯ বছর পার হলেও শেষ হয়নি তাদের তদন্ত। এটি ‘ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’ হলেও এখনও সংশ্লিষ্ট পাঁচ দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পায়নি বাংলাদেশ। দেশগুলো হলো– যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া।

চাঞ্চল্যকর এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত শেষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে এসব দেশের সহযোগিতা জরুরি। যদিও এই মামলা ঘিরে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় ভুল ধারায় মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার নামও উঠে আসে। তারা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় মামলাটি তদন্তের এখতিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। এটি দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ। গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও সিআইডি থেকে উত্তর মেলেনি। এদিকে এই ঘটনায় বিদেশি ৭৬ নাগরিকের সংশ্লিষ্টতাও মিলেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর পর্যন্ত ১ হাজার ৯২৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক করার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি হ্যাকার গ্রুপটি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘটনার অন্তত ১৩ মাস আগে থেকে হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লেনদেনের কমিউনিকেশন সিস্টেমে ভাইরাস ঢোকানো হয়। এর পাঁচ মাস পর ওই বছরের মে মাসে ফিলিপাইনের ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব নম্বর খোলা হয়। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে হ্যাক করে রিজার্ভের অর্থ সরানো হয়।

শুরুতে ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানসহ অনেকে জানলেও তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনা যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য তিনি সবাইকে কঠোর নির্দেশনাও দেন। ঘটনাটি ধামাচাপার চেষ্টা চালানো হয়। শুরুর দিকে ফিলিপাইনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানালে হ্যাকারদের কাছে পৌঁছানোর আগে এ অর্থ জব্দ করা যেত। এই উদ্যাগ না নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইনের ব্যাংকে কয়েকটি ই-মেইল করে দায়িত্ব সারে। এতে কোনো কাজই হয়নি। হ্যাকিংয়ের আট দিনের মাথায় ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকেও টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, ঘটনার ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলায় চুরি, আইসিটি ও মানি লন্ডারিং ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে মূলত হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে। এজাহারে চুরির কথা বলা না হলেও মামলায় চুরির ধারা দেওয়া হয়। আইনে হ্যাকিংয়ের স্পষ্ট ধারা থাকলেও সেটি মামলায় উল্লেখ করা হয়নি। জড়িতদের সুবিধা দিতেই এই কাজ করা হয়। এ ছাড়া তদন্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হ্যাকাররা সুইফট সিস্টেম ঢোকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৬ মিনিটে। রাত ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত তারা সুইফট সিস্টেমে অবস্থান করে। সিআইডি ওই বছরের ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু জিনিসপত্র জব্দ করেন। হ্যাকারসহ বিভিন্ন তথ্য পেতে ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে জাপান, ভারত ও ফিলিপাইন উত্তর দিয়েছে। অন্যরা আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফিলিপাইনের ৪২, শ্রীলঙ্কার আট, চীনের ১৭, ভারতের আট ও জাপানের একজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে মূল হ্যাকার হলেন পার্ক নামে উত্তর কোরিয়ার এক প্রোগ্রামার। তারা চীনে বসে একটি কোম্পানি খুলে হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি ঘটান। হ্যাকারদের অধিকাংশ উত্তর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত চীনের নাগরিক। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৪.৬১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার হয়েছে। বাকি ৬৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন এখনও বেহাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করেছে। মামলায় জিততে পারলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় যে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেখানে হ্যাকিংয়ের অনেক তথ্য গায়েবের বিষয় উঠে এসেছে। সেখানে ঘটনাক্রমে অমিল পাওয়া যায়।

আরেকটি সূত্র বলছে, অর্থ সরানোর ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। তাদের সবার বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান নিষেধাজ্ঞার আগেই দেশ ছাড়েন। অন্য যাদের নামে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আছে তারা হলেন–সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, সাবেক উপপরিচালক (সুইফট অপারেটর) জি এম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন ও একলাস উদ্দিন।