টিকফা’র ঢাকা বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে গণতন্ত্র ও শ্রমঅধিকার

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা, তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের শুল্ক ছাড় এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার পর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশটির ঐকান্তিক সহায়তা চায় বাংলাদেশ।

টিকফা’র ঢাকা বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে গণতন্ত্র ও শ্রমঅধিকার

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা, তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের শুল্ক ছাড় এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার পর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশটির ঐকান্তিক সহায়তা চায় বাংলাদেশ। অন্যদিকে কারখানার যথাযথ নিরাপত্তা বিশেষত কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম বন্ধ এবং মেধাস্বত্ব বিষয়ক জটিলতার দ্রুত সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নির্বিঘ্ন করতেই পারস্পরিক এমন চাওয়া। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) আসন্ন বৈঠকেও তা নিয়ে আলোচনা হওয়ার আভাস মিলেছে। আগামী বুধবার ঢাকায় বসছে টিকফার সপ্তম কাউন্সিল বৈঠক। বাংলাদেশের পক্ষে এতে নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। টিকফা বৈঠকে অংশ নিতে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী ইউএসটিআর ক্রিস্টোফার উইলসের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকা আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এবারের বৈঠকে রুটিন আলোচনার বাইরেও কথা হবে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। 

এক কর্মকর্তা বলেন, এজেন্ডায় না থাকলেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আলোচনার সূত্র ধরে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা তুলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই বৈঠক প্রস্তুতি চূড়ান্ত হচ্ছে। আগামীকাল (সোমবার) সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা হবে। টিকফা বৈঠকের হোস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই প্রস্তুতি-বৈঠকের আয়োজন করছে। এতে পররাষ্ট্র, শ্রম, কৃষি, তথ্য, তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। 

স্মরণ করা যায়, গত ক’মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বৈঠক হয়েছে তার সব ক’টিতেই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্টের গ্লোবাল অ্যান্টি করাপশন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ’র সফর। তাছাড়া চলতি বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। সেই সব সফর এবং আলোচনায় মোটা দাগে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, আইনের শাসন সহ দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, নন-ট্র্যাডিশনাল নিরাপত্তা সহযোগিতা যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, মানবপাচার সংক্রান্ত সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেই সব আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হলেও দু’পক্ষই বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে। সম্প্রতি তুলা আমদানির বিষয়ে জটিলতা নিরসনের পর আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি আরও বাড়বে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োকারী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। 

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি খাতে তারা বিনিয়োগ করেছে এবং আরও করতে আগ্রহী। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, আইনের শাসন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অবস্থান থাকলেও দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, একটির সঙ্গে আরেকটি ইস্যুর যথেষ্ট মিল রয়েছে। উন্নয়ন অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র সিভিল লিবার্টি যেমন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত উদ্বেগ জানাচ্ছে। তাদের বিবেচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে সিভিল লিবার্টি। এ ছাড়া আইনের শাসন ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে এবং বিভিন্ন স্তরে এ বিষয় নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীদিনেও হবে বলে ধারণা মিলেছে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক মনে করেন দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যোগাযোগ ও আলোচনা চলবে, এটাই নিয়ম। আলোচনায় যেকোনো পক্ষ যেকোনো বিষয় তুলতে পারে। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই মতপার্থক্য দূর করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

দীর্ঘ সময় পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বপালনকারী মিস্টার হক বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্কে গতিশীলতাই মুখ্য। যে বিষয়ে মতের অমিল হবে, আবার মিলও হয়ে যাবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আগেও ছিল, এখনো আছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে সময় ও প্রেক্ষাপট- এমন মন্তব্য করে  শহীদুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তি হচ্ছে মূল্যবোধ ও মানবাধিকার এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে তারা বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে থাকে। যে কোন আলোচনায় এটি তারা উত্থাপন করে থাকে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আসন্ন টিকফা বৈঠক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ নির্বাচনকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পারে এ বৈঠক। তার মতে, বৈশ্বিক সংকটসহ বড় বড় ইস্যু অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। সেক্ষেত্রে বড় জোটগুলো যেমন জি-২০ এ ধরনের গ্রুপ, তারা সহায়তা দিতে পারে কিনা সেটি আলোচনায় বলতে হবে। 

এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যা আলোচনায় স্থান পেতে পারে বৈঠকে। তিনি আরও বলেন, স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বের হওয়ার পর বাণিজ্য সংকটে পড়ার মুখে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বিশেষ করে শুল্কমুক্ত, ট্যারিফের মতো বিষয়গুলো শিথিল করার আহ্বান জানাতে পারে ঢাকা। গত বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা ষষ্ঠ কাউন্সিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অগ্রাধিকার বাজারসুবিধা চায় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলনায় পোশাক তৈরি করে সে দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশটি যাতে শুল্ক আরোপ না করে, বাংলাদেশ সে প্রস্তাবও দেয়।