গাসিক নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই ভোটারদের: আচরণবিধি ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় মন্ত্রী এমপিরা
প্রথম নিউজ, গাজীপুর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন দিন বাকি থাকলেও নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারের কোন আগ্রহ নেই। নির্বাচনী মাঠে নেই দেশের বৃহত্তম রাজনীতিকদল বিএনপি। ফলে একতরফা ভোটের প্রতি মানুষের নেই কোন মনোযোগ । সাধারণ ভোটরদের ধারণা পূর্বের মতোই সরকার দলীয় মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। বেছে বেছে মেয়রের পছন্দের কাউন্সিলর প্রার্থীকেই বিজয়ী করে কোরাম পূর্ণ করা হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বললেও তাদের আচরণও আগের দুটি কমিশনের মতোই। সরকার দলীয় প্রার্থীদের পক্ষেই তাদের অবস্থান। খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী প্রার্থী ও বর্তমান বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। অন্যদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা চলছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মন্ত্রী এমপিরা নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান গত ২৭ এপ্রিল মনোনয়নপত্র জমা দেন। সেদিন নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে পাঁচজনের বেশি লোক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় তাকে নোটিস দেয় ইসি। নির্বাচন কমিশনে হাজির হয়ে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। পরে একজন প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে আজমত উল্লা খানকে গত বৃহস্পতিবার ফের ইসি থেকে চিঠি দেওয়া হয়। তাকে ৭ মে বিকেলে নির্বাচন কমিশনে হাজির হয়ে আচরণবিধি ভঙ্গের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে গাজীপুরের সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলকে দুই দফা সতর্ক করা হয়। একইভাবে গাজীপুরের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককেও নির্বাচন কমিশন থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন সম্পর্কে অবহিত করে চিঠি দেওয়া হয়। আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুনকে চিঠি দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
এ নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে গাজীপুর শহরের অদূরে বাড়িয়া ইউনিয়নের শুকুন্দি গ্রামের একটি রিসোর্টে গাজীপুর সদর মেট্রো থানা আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর যৌথ কর্মিসভা হয়। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হবে এজন্য শহরের বাইরে সদর মেট্রো থানায় এ কর্মিসভা করা হয়। যাতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। মেট্রো সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওয়াজউদ্দিন মিয়ার সভাপতিত্বে যৌথ কর্মিসভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সংসদ সদস্য মির্জা আজম, গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মো. কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্যাহ মন্ডল প্রমুখ।
এদিকে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরাও আচরণবিধি ভঙ্গের উৎসবে মেতে উঠেছেন বলে অভিযোগ অনেকের। নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতীক বরাদ্দের আগেই আগাম পোস্টার ছেপে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যাদের প্রতীক মোটামুটি নিশ্চিত সেসব কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের প্রার্থীদের প্রতীক সংবলিত পোস্টার। চাওয়া হচ্ছে ভোট।
নগরীর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আবদুল মান্নান মিয়া নামে এক প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি প্রতীক সংবলিত পোস্টার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এ ছাড়া গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরা মসজিদে গিয়ে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে ভোট ও দোয়া প্রার্থনা করেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, আমি এখনো পোস্টারই ছাপাইনি। কে বা করা এগুলো ছেপে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে।
নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইতেও দেখা গেছে। উঠান বৈঠক, পরামর্শ সভা, কর্মিসভা ও সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে নানাভাবে প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে ভোট চাচ্ছেন।
এভাবে গণহারে আচরণবিধি ভঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। সরকারদলীয় সমর্থক মেয়র প্রার্থী ও দলের নেতারা অহরহ আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রভাবশালী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। অনেকেই আইনকানুন মানছেন না।’ আচরণবিধি ভঙ্গ করা রোধে নির্বাচন কমিশনকে আরও কঠোর ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, ‘অনেক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে আচরণবিধি মানছেন না। ৯ মে প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর কথা থাকলেও বিভিন্ন উপায়ে প্রার্থীরা আগাম প্রচারণা শুরু করেছেন। যা আচরণবিধির লঙ্ঘন। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব প্রার্থী নির্বাচনের আচরণবিধি ভেঙে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নগরীর ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে ১৯ জন সহায়ক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। সবাইকে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে হবে।’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাজহারুল আলম বলেন, ১০ বছর ধরে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে সরকার। মরহুম অধ্যাপক এম এ মান্নান মেয়র পদে নির্বাচিত হলেও দায়িত্বপালন করতে পারেননি। কাউন্সিলর দিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করানো হয়েছিল। এখনও তাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে গাজীপুরের মানুষের অধিকারও প্রতিষ্ঠা হবে না। তিনি আরও বলেন সিটি কর্পোরেশনের একতরফা নির্বাচনের আয়োজন বিএনপির আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশলমাত্র। জনগণ এমন নির্বাচনে নাই। তারা ভোট কেন্দ্রেও যাবে না, এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবে।