স্বাধীনতার হুইসেলব্লোয়ার

উনিশ শ' একাত্তর সালের সালের শুরুতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন 'সামান্য মেজর'। হ্যাঁ ছিলেন। অসুবিধা কী? তবে এই সামান্য মেজরটিই একটি অসামান্য কাজ করেছিলেন।

স্বাধীনতার হুইসেলব্লোয়ার

প্রথম নিউজ, ডেস্ক: উনিশ শ' একাত্তর সালের সালের শুরুতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন 'সামান্য মেজর'। হ্যাঁ ছিলেন। অসুবিধা কী? তবে এই সামান্য মেজরটিই একটি অসামান্য কাজ করেছিলেন। তখন যারা অসামান্য লোক ছিলেন তারা একটা সামান্য কাজও করতে পারেন-নি। জিয়া ছাড়াও আরো কয়েকজন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানী মেজর তখন পাকিস্তানী শাসন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। পাকিস্তানী ফৌজি সরকার বাংলাভাষী নিরস্ত্র ও সশস্ত্র নাগরিকদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল বাংলাভাষী সেই মেজররা সেই আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন। তবে জিয়া কেবল বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের লড়াই-ই শুরু করেন-নি। তিনি ইতিহাসে পৃথক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন আরেকটি অসামান্য ভূমিকা পালনের মাধ্যমে।

তাঁর ভূমিকাকে ক্ষুণ্ণ করতে বলা হয়, একজন মেজরের হুইসেলের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসেনি। কথা সত্য। কেবল একজনের ভূমিকায় একটা দেশের ও জাতির স্বাধীনতা আসেনা। এক দীর্ঘ সংগ্রামী প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং অবশেষে রক্তক্ষয়ী এক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। কোটি কোটি মানুষের অপরিমেয় ত্যাগ এবং অগণিত মানুষের প্রাণদান ও অবদান রয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পেছনে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কাউকে হেয়, তুচ্ছ ও খাটো করার সুযোগ নেই। জিয়ার ভূমিকাকেও হেয় করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই বিকৃত ও খর্ব হয়ে যায়। জিয়া আসলে ছিলেন আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের তুর্যবাদক বা হুইসেলব্লোয়ার। এই হুইসেল বাজানোকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়। স্বাধীনতার পর নিরাপদ সময়ে প্রচারণার ধুম্রজালে সেই অসামান্য ভূমিকাকে তাচ্ছিল্য করা খুব শস্তা কিন্তু সেই ঘোর অমানিশার অন্ধকারে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে জিয়া যা করেছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে। ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানী সেনারা নিধনযজ্ঞ শুরু করলে চট্টগ্রামে কর্মরত 'সামান্য মেজর' জিয়া বিদ্রোহ করেন। সামরিক কৌশলে প্রতিপক্ষকে বন্দী করেন। নিজের ইউনিটের অনুগত বাংলাভাষী সৈনিকদের উদ্দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে শপথ করান। প্রতিরোধ যুদ্ধ আরো অনেক জায়গায় হয়েছে কিন্তু জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষনাটা দেন।

এরপর তিনি কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা ইথারে ছড়িয়ে দেন সবখানে। স্বাধীনতা যখন সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জনের বিষয়, তখন নিরস্ত্র কারো ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। রণাঙ্গনের একজন সামান্য মেজরের ঘোষণাই তখন অসামান্য হয়ে ওঠে। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষ একজন যোদ্ধার ঘোষণাতেই তখন ভরসা পায়। জিয়া জাতিকে সেই বরাভয়ই শুনিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি পাকিস্তানী শাসন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে তাঁর ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে উন্নীত করেছিলেন। জিয়া বেতারে একবার একটা ঘোষণা দিয়েই সটকে পড়েন নি। তিনি কয়েকদিন ধরে বারবার ঘোষণা দিয়েছেন। একই ঘোষণা নয়। ছোটো বড় অনেকগুলো ঘোষণা। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধান সামরিক অধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে সে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এটা না করলে মুক্তিযুদ্ধ বৈধতা পেতো না। কেননা এই ভূখণ্ডে তখন পাকিস্তান সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব ছিল। সেই কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একটি পালটা শাসন কাঠামো দাঁড় না করালে স্বাধীনতা যুদ্ধ বৈধতা অর্জন করেনা। জিয়া সে কাজটিই করেছিলেন। 'আমি মেজর জিয়া বলছি' বলে নিজের নামেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা তিনি মোচন করেছিলেন সেই দুঃসাহসী ও ঐতিহাসিক সঠিক ভূমিকার মাধ্যমে। অতুলনীয় দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি এবং ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা জিয়ার মধ্যে ছিল না। কেননা চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ মেনে তিনি তাঁর ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। কেননা, পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী শেখ মুজিব তখন ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা। তাঁর নামে ঘোষণা হলে সেটির গ্রহনযোগ্যতা বাড়ে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকে না। তাই জিয়া তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণায় উল্লেখ করেন 'অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমান' তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠন করেছেন। ইংরেজিতে দেয়া ঘোষণাগুলোতে জিয়া বারংবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বীকৃতি চেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও নীতিমালার কথাও ঘোষণা করেন। জিয়া ছাড়া তখন বাংলাদেশের কোনো ঘোষিত সরকার ছিল না এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো ঘোষিত অধিনায়কত্বও ছিল না।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তদানীন্তন বৃহত্তর সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাংলাদেশের সামরিক অধিনায়কদের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিফৌজ গঠন, সেক্টর বিভাজন, অধিনায়কদের দায়িত্ব অর্পণ এবং এম.এ.জি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক করা হয়। এর মাধ্যমে অস্থায়ী প্রধান সামরিক অধিনায়ক হিসেবে জিয়ার আপদকালীন ভূমিকার অবসান ঘটে। তাঁকে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ও পরে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিফৌজ গঠনকালেই বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই আলোকে ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মুজিবনগর সরকার নামে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে সেই সরকারের শপথ গ্রহন ও অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব গ্রহনের মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে জিয়ার সাময়িক দায়িত্বেরও অবসান ঘটে।
স্বাধীনতার হুইসেলব্লোয়ার হবার দায়িত্ব সহজ নয়। কোনো গোপন চিরকুট দিয়ে বা এর-ওর মারফত সেটা করা যায়না। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সদর্পে সদম্ভে স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করা, পাকিস্তানী শাসন কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে পালটা শাসন ও সামরিক কর্তৃত্বের প্রধান ঘোষণা করা এক ঐতিহাসিক অসামান্য কাজ। এক সামান্য মেজর সেই অসামান্য কাজটি করেই ইতিহাসে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছেন। অনেক জাতির রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতাযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধে রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা আলাদা। এক হাজার মাইল দূরবর্তী দু'টি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্রের প্রকৃতিও আলাদা ছিল। প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র-তরুণ ও সাংস্কৃতিক বলয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হওয়া সত্বেও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মান্যতা পেলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু না হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর সে বৈধ অধিকার লাভের চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন। এটাই ছিল ন্যায়সঙ্গত।

তবে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আলোচনার ছলে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাতের অন্ধকারে কাপুরুষোচিত মারণযজ্ঞ শুরু করে। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহ সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব বন্দী হন। অন্য নেতারা পালিয়ে যান। সে সময়ের কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করলেই বুঝা যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কতটা ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুধাবন করা যায় কে কত বড় যোদ্ধা ও বীর। বাংলাভাষী অনেক সেনা অফিসার পাকিস্তানী হানাদারদের পক্ষ নিয়েছেন। কেউ তাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন, কেউ নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। আবার অনেকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছেন। জিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালন করেছেন এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা। তাই এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এদেশের স্বাধীনতা যতদিন অক্ষুন্ন থাকবে ততদিনই জাতির অন্তরে ও ইতিহাসে দেদীপ্যমান থাকবেন জিয়াউর রহমান।
লেখক: মারুফ কামাল খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ; সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন  (ফেইসবুক ওয়াল থেকে)।