উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে না মেহেরপুরের হাজারো শিক্ষার্থী

শিক্ষকদের কাছে উপবৃত্তির তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও টাকা পাওয়া যায়নি। অনেকের অভিযোগ, শিক্ষকদের বারবার বলার পরে কয়েকজন পেলেও তা সঠিক সময়ে পাচ্ছে না।

উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে না মেহেরপুরের হাজারো শিক্ষার্থী

প্রথম নিউজ, মেহেরপুর: পড়াশোনার পথ সুগম করতে সরকার উপবৃত্তি চালু করলেও এমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মেহেরপুরের হাজারো শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের কাছে উপবৃত্তির তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও টাকা পাওয়া যায়নি। অনেকের অভিযোগ, শিক্ষকদের বারবার বলার পরে কয়েকজন পেলেও তা সঠিক সময়ে পাচ্ছে না। আবার অনেকেই উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও সুরাহা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ফলে নানা সমালোচনার মুখে পড়ছেন শিক্ষকরাও।

জানা গেছে, মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় ৩০৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ সকল বিদ্যালয়ে এ বছর প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ১১ হাজার ৯৯৮ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১৪ হাজার ২১৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৩ হাজার ৯৩৫ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ১৩ হাজার ৫৯১ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৩ হাজার ১৮৭ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১২ হাজার ৭৬০ জন শিক্ষার্থী লেখাপাড়া করে। এ সকল শিক্ষার্থীদের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ৭৫ টাকা এবং অন্যান্য শ্রেণিতে মাসিক ১৫০ টাকা করে সরকার বছরে দুইবার মোবাইলের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করে থাকে।

প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হলে টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে তা পরিবর্তন হয়ে ‘বিকাশ’ একাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হতো। বিকাশের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের সময় একটি ম্যাসেজের মাধ্যমে উপকারভোগীকে নিশ্চয়তা বার্তার মাধ্যমে তা জানানো হতো। পরে বিকাশ পরিবর্তন করে বর্তমানে ‘নগদ’ একাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। নগদ একাউন্টের মাধ্যেমে টাকা প্রদানের পর উপকারভোগীদের মোবাইলে কোনো নিশ্চয়তা বার্তা (ম্যাসেজ) না দেওয়ায় অনেকেই ধোঁয়াশায় থাকেন। টাকা না পাওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়েন বিদ্যালয় শিক্ষকরা।

গাংনী উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রযেছে ১৬২টি। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সরকারি নিয়মনুযায়ী শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দিয়ে শতভাগ সকল শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির সুবিধার আওতায় নিয়েছে বর্তমান সরকার। অথচ সরকারের এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত রয়েছেন সেই সকল কর্তাব্যক্তিদের অবহেলায় অনেক শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। গাংনী সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভেজ সাজ্জাদ রাজা  বলেন, তার বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৫৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে ২৯ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। বিষয়টি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে জানানো হলেও কোনো সুরাহা মেলেনি। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম, আলজারির, রাধিকা জানায়, তাদেরও সহপাঠিরা অনেকেই উপবৃত্তির টাকা পেয়েছে। তারা আজও পায়নি। শিক্ষকদের বলেও কোনো কাজ হয়নি।

বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বিদ্যালয়ে ১৪০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। এদের মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। উপবৃত্তি বঞ্চিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আমাদের কাছে আসলেও কোনো উত্তর দিতে পারি না। এমনকি আমরা কোথায় অভিযোগ করব তাও জানি না। এদিকে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী আছিয়া, তাছিম, উম্মে সালমা, হাবিবা, লিমা এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষকরা বলে তোদের নাম উপবৃত্তির তালিকায় আছে। কিন্তু আজও টাকা আসেনি। তাদের কয়েকবার মোবাইল নম্বর সঠিক আছে কি না তা দেখা হয়েছে। সব ঠিক আছে কিন্তু টাকা আসে না বলেও জানায় তারা।

বড় বামুন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম হাসান বলেন, বিদ্যালয়ের ৭৮ জন শিক্ষার্থীরমধ্যে মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। এছাড়া, পিরতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৯০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার ফয়জুন নেছা। সাহারবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দানেসুর রহমান জানান, ১৫৬ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী এবং ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, ১৫ জন শিক্ষার্থী এ বছর বঞ্চিত হয়েছে সরকারের এই উপবৃত্তি সহায়তা থেকে।

শিক্ষকদের জানান, শিক্ষার্থীদের মোবাইল নম্বর ও কাগজপত্র সঠিক থাকা সত্ত্বেও তারা উপৃত্তির টাকা পাচ্ছে না। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও কোনো জবাব দিতে পারছেন না তারা। শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ‘নগদ’ একাউন্টে টাকা প্রদান করা হলে মোবাইলে কোনো ম্যাসেজ না আসাকেই বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন তারা। এতে টাকা প্রদানের বিষয়ে জানতে পারছে না উপকারভোগীরা। এভাবে অন্তত কয়েক হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তির এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে প্রকৃতপক্ষে কতজন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি থেক বঞ্চিত রয়েছে তার কোনো সঠিক সংখ্যা জানা নেই বলেও জানান তারা।

শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার বিষয়ে গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আলাউদ্দীন বলেন, উপবৃত্তি বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে মৌখিকভাবে অবহিত করেছেন। আমি তাদের তালিকা করে পাঠাতে বলেছি। তালিকা পেলে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ভুপেশ রঞ্জন রায় বলেন, গত বছর মেহেরপুর জেলায় প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থীর উপবৃত্তিতে সমস্যা হয়েছিল। এমন অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি আমরা টাকা প্রদান কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পরে সকলেই টাকা পেয়েছিল। চলতি বছরের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরেও অভিযোগ পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, অনেকেরই মোবাইল নম্বর সঠিক  থাকে না, কারও আবার মোবাইল পিন নম্বর অন্যদের জানা থাকে। তারা টাকা তুলে নেয়। এ সকল কারণেও টাকা থেকে বঞ্চিত হতে পারে শিক্ষার্থীরা।